প্রিয় মানুষের অবহেলা গল্প
এক ঘর লোকের সামনে ষাটোর্ধ মেহেরুন চাচীকে নিশি জোরে থাপ্পড় বসাতেই সবার মুখ হা হয়ে গেল।
চাচী কিছু বুঝতে পারার আগেই হুমড়ি খেয়ে সোফায় বসতে গিয়ে কাছ ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পড়লো।
চিরকাল শান্ত আর ভদ্র স্বভাবের মেয়ে নিশি। তার কোন ভাইবোনের সাথে তার কোন দিন ঝামেলা হয় নি মারামারি তো দূরের কথা।
বিয়ে হয়েছে ছয় বছর হলো, শ্বশুর বাড়িতে ওর নরম স্বভাবের জন্য ও বেশ সমাদৃত। ওর একটা মেয়ে আছে সাড়ে চার বছর বয়েসে মেয়েটার নাম রিয়া, গত নভেম্বরে ওর একটা ছেলে হলো রিয়ান।
বেশ ভালো মেয়েটা পরিবারের সবার সামনে এমন একটা আচরণে কেউ কিছু মেলাতে পারছে না। আমার মাথায় প্রথমে এলো বেবি হওয়ার পর ডিপ্রেশনে মেয়েটা কিন্তু তা বলে এমন কিছু?
সবার হতভম্ভ ভাব কেটে গেল এখন চেঁচামেচি শুরু হলো সবাই প্রশ্ন করতে লাগল। নিশির চাচার বাসা এইটা। আজ এইখানে সবার খাওয়ার দাওয়াত। নিশিদের ও করা হয়েছিল ওরা আসতে পারবে না বলে জানিয়েছিল। পরশু দিন ওর ছোট ছেলের জন্য অনুষ্টান করা হয়েছিল সেখানে সবাই গিয়েছিল। সবাই ভেবেছে ওরা ক্লান্ত।
কিন্তু এমন আলু-থালু নির্ঘুম চেহেরা নিয়ে মেয়েটা এসে এমন ভাবে চাচীকে থাপ্পড় লাগাবে কেন?সবার প্রশ্নের জবাবে এইবার সে চুপ। নিশির মা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। এমন কান্ড শুনে তিনি বিশ্বাসেই করতে পারছেন না। কিন্তু মেয়ের এমন চেহেরা আর মেহেরুন চাচীর এইভাবে পড়ে থাকা দেখে সবার কথা তাকেও মানতে হল তার মেয়ে এত বেয়াদব হয়ে গেল।
নিশি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে সাপের মতো ফোঁপাচ্ছে।বিন্দুমাত্র থামছে না ওর এই বিচ্ছিরি ফোঁপানোটা। নিশির মা কাছে গিয়ে অলতো করে জিজ্ঞেস করল,
-কি হয়েছে? তুই এইখানে এইভাবে? কি হয়েছে তোর?
উনি আলতো স্বরে বলে ওকে বসানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এক বিন্দু ও নড়ছে না। এইবার মেহেরুন চাচী দাঁড়িয়ে চেচিয়ে উঠলো,
- এত বড় সাহস তোর? আমার গায়ে হাত তুলছিস?
উনিও এইবার তেড়ে এলেন নিশিকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য।
সবাই উনাকে থামানোর চেষ্টা করলে রেগে ফুসে উনি সোফায় বসে এইবার কান্নার ভেঙে পড়লেন।
-এইটুক বয়স থেকে কোলে করে মানুষ করেছি যখন সবাই এক সাথে ছিলাম। সে মেয়ে নাকি আমার গায়ে-
বাকি কথা উনি শেষ করতে পারেন নি তার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
সবাই নিশিকে একে একে প্রশ্ন করছে কি হয়েছে? এমন আচারণের কারণ কি?
উনিও এইবার চেঁচিয়ে উঠলেন,
-কি হলো বলছিস না কেন? কি করেছি আমি? এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি?
নিশি এইবার শান্ত গলায় বলল-
-তুমি আমার বাচ্চাদের খুন করতে চেয়েছো। আরেক টু হলে মরেই যেত। বাঁচাতে পারব কিনা জানি না।
সবার কথা থেমে গেল, প্রথমে অবাক হলেও একটু পর চাপা গুঞ্জন উঠল, কি বলে? কী হয়েছে?কীভাবে?
মেহেরুন চাচী উঠে দাঁড়িয়ে বলল -
- ফাজলামি করার আর জায়গায় পাস নি নিশি?সেদিন তোর বাচ্চা গুলোকে এত আদর দিয়ে এলাম আমি আর বাসায় এলাম দুদিন পর বলিস আমি তোর বাচ্চা খুন করতে চাইছি? কি করেছি আমি?
নিশি নিস্পৃহ গলায় এখন হাল্কা চাঞ্চল্যের ভাব,
কিংবা কান্না আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা,
- তুমি আমার মেয়ে রিয়াকে কি বুঝিয়েছো? এইটুক একটা মেয়ের মনে এইভাবে বাজে কথা ঢুকানোর আগে দ্বিতীয় বার চিন্তা কর নি?
সবার মতো চাচীও অবাক হয়ে বলল,
-ভনিতা রাখ নিশি। তোর মেয়ের সাথে আমার কি? এত ছোট মেয়ের মনে আমি কীভাবে কি বাজে কথা দিতে পারি? কখনো না।
নিশি এইবার চেঁচিয়ে উঠল,
- দিয়েছো, তুমি ওকে বলেছো আমরা ওকে ভালোবাসি না। আমি ওকে ভালোবাসি না। আর কখনো আদর করব না। ওর কোন জায়গায় নেই আমাদের ঘরে আমাদের মনে। সব কিছু এখন আমার ছেলের। ওকে কোন কিছুই দেওয়া হবে না।
কথাটা শুনে, 'ও' বলে হাসতে গেলেন চাচী,
কিন্তু নিশির চেহেরাটা দেখে হাসি থামিয়ে বলল,
- এই আর তেমন কি? আমি তো মজা করছিলাম। আমরা সবাই তো কম বেশি নাতি নাতনীদের সাথে এমন মজা -
উনি কথা শেষ করার আগে নিশি হুংকার দিয়ে উঠলো,
- তোমার আর তোমাদের এই সস্তা রসিকতার জন্য আমার নিষ্পাপ দুইটা বাচ্চা আর জীবন মরণ নিয়ে যুদ্ধ করছে। দুইটা আই সি ইউ তে। জানি না বাঁচাতে পারব কিনা?
বলতে বলতেই মুখে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ঢুকরে কেঁদে সোফায় বসে গেল নিশি।
পরিবেশ টা থমথমে হয়ে গেল। নিশি সমানে কেঁদে যাচ্ছে। কেউ কোন শব্দ বের করতে পারছে না। এই পৃথিবীতে নাকি সন্তানের জন্য মায়ের কান্না আটকানো আর সান্ত্বনা দেওয়ার ক্ষমতা কোন মানুষের মধ্যে দেওয়া হয় নি।
নিশির মা ধুম করব বসে পড়লেন কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন,
-কী বলছিস এইসব? কী হয়েছে বাবুদের? কীভাবে?
নিশি কান্না করতে করতে এইবার হেঁচকি দিয়ে উঠলো।
নিজেকে সামলে অনেকক্ষন পর বলল,
- গত কাল সকালে আরিফ অফিসে যাওয়ার পর আমি রিয়ান কে ঘুম পাড়িয়ে রান্না ঘরে গেলাম। আগের দিনের সব এলোমেলো কাজ গোছাতে।
রিয়া ওর মতো টিভি দেখে খেলছিল। একটু পর রান্না ঘরে এসে বলে,
- মা আমাকে একটু কোলে নিবে?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
-এখন কি আমার কোলে নেওয়ার সময়? যাও খেল।
ও গেল না, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, যাও। পরে নিব।
ও চলে যাওয়ার একটু পর রিয়ান দোলনায় কান্না করে উঠলে, আমি কাজ ফেলে দ্রুত ছুটে যাই। কোলে নিয়ে কান্না থামাই।
তখন রিয়া এসে বলে, তুমি আমাকে কোলে নাও নি ভাইকে কোলে নিলে। তুমি আসলে আমাকে ভালোবাস না। তুমি আমার মা না। সব ভালোবাসা ভাইয়ের জন্য।
আমি খানিক টা ধমক দিয়ে বললাম, এইটা কি ধরনের কথা মা, কে বলেছে তোমাকে আমি তোমাকে ভালোবাসি না। অবশ্যই বাসি। কিন্তু ভাই তো ছোট। ওকে তো নিতে হবে। তুমি তো একটু বড় হয়েছো। এতদিন তোমাকে আদর করতাম না? তুমিও তো করতে আদর ভাইকে। হঠাৎ কি হলো?
- আগে করতে এখন কর না। এখন সব কিছু ভাইয়ের জন্য। ও পঁচা। ওকে আমি ঘর থেকে বের করে দিব।
এইবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে দেখে আমি ধমক দিলাম,
- কি বল মামুনি এইসব? এইসব কথা বলে না। যাও খেলতে যাও।
তখন সে চুপ হয়ে চলে গেলে আমি ভাবলাম আপাতত শান্ত হয়েছে। এতদিন ধরে একা আদর পেয়েছে হয়ত এখন অনুভব করছে।কিন্তু আমরা ওকে আলাদা বা দূরে রাখি নি হঠাৎ এমন আচরণে আমি খানিকটা অবাকেই হয়েছি। কারণ হওয়ার আগে থেকেই ওকে আমরা জানিয়েছি ইনভলব করেছি সবকিছু তে। সে এতদিন এইধরনের কোন কথা বলে নি। আসেই নি ওর মনে হঠাৎ এমন কথা কেন? ভাবলাম ফ্রি হয়ে ওকে নিয়ে বসব।
অনেক কাজ জমে ছিল আমি রান্নাঘরে গেলাম। বেশ কিছু ক্ষন পর আমি রিয়ানের জোরে চিৎকার শুনলাম। আমি তাড়াতাড়ি এসে দেখি রিয়ান নেই, রিয়াও নেই।
দুজন কে ডাকলাম। একটু পরে ওয়াশরুম কল ছাড়ার আওয়াজ।
আমি এক বালতি কাপড় ভিজিয়েছিলাম বাবুর আরিফের। ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল।
আমি ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলাম, রিয়া বালতির কাপড় বের করে রিয়ান কে বালতিতে ডুবিয়ে মাথা চেপে ধরেছে।
আমার মুখ দিয়ে যেন শব্দেই বের হচ্ছিল না। আমি তাও জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম,
- রিয়া কি করছিস তুই?
আমি চিৎকার শুনে রিয়া ভয়ে পেয়ে গেল। দৌঁড়ে বাথরুম থেকে বের হতে গিয়ে সবান ডুবানো কাপড়ে পিছলা খেয়ে দেওয়ালে বারি খেয়ে ফ্লোরে পড়ে গেল।
কিছু বুঝতে পারার আগেই বিয়ার মাথা থেকে গলগলিয়ে রক্ত বের হয়ে গেল। আর রিয়ানের কোন সাড়া নেই।
রিয়ান কে পানি থেকে তুলে রিয়াকে বুকে তুলে নিয়ে আমি কীভাবে যে দুইটা বাচ্চা নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছি, এক আমি জানি আর আমার খোদা জানে।
বলতে বলতে ওর গলা যেমন ধরে গেল, তেমনি সবার গলায় কি যেন এসে আটকে গেল। চোখ বেয়ে কখন পানি গড়িয়ে পড়লো কারো খেয়াল নেই।
নিশি আবার বলা শুরু করল,
কাল পুরো দিন রাত গেল কোনদিকে আমি আর আরিফ জানি না। কাউকে খবর ও দেওয়া হয় নি। কাল আরিফ কে ফোন করেছিলাম শুধু। আজ মোবাইল হাতে নিলাম তোমাদের ফোন দিব বলে।
তখন দেখলাম মোবাইলে একটা ভিডিও।
রিয়া নিজে নিজে তুলেছে। জানি না কি ভেবে করেছে, ও মাঝেমধ্যে এমন ভিডিও বানায়। ভিডিও অন করে ছড়া বলে, নাচে।
নিশি মোবাইল টা বের করে ভিডিও টা অন করে দিল। রিয়া ও তার একটা পুতুল, কিছুটা সিলিং দেখা যাচ্ছে কিছু টা ওদের।
রিয়া হয়ত ওর পুতুল কে বলছে,
- মা আমাকে আর একটু ও ভালোবাসে না। কাল নানী এসেছিল যে বলেছে, মা এখন থেকে আমাকে ভালোবাসবে না। আদর দিবে না। সব কিছু ভাইয়ের জন্য।
মা আমাকে আগে বুকে নিয়ে ঘুমাতো। এখন আর ঘুমায় না। আগে খাওয়াই দিতো এখন বলে তুমি তো বড় বোন তোমাকে নিজে নিজে খেতে হবে।
আমার তো বড় হতে হবে না। আমার ছোট থাকতে ইচ্ছে করে। বাবা শুধু আমার জন্য খেলনা আনবে আমার জন্য ড্রেস আনবে।
আগে সবাই আমার জন্য আনতো এখন শুধু ভাইয়ের জন্য আনে।
জানো এইগুলো কাল আমাকে মেজ নানী বলেছে। নানী শুধু আমাকে ভালোবাসে তাই আমাকে আদর করেছে।
বাকিরা সবাই ভাইকে কোলে নিয়েছে আদর করেছে। আমার জন্য কেউ একটা চিপস ও আনে নি।
নানী বলেছে , ভাই আমার সব আদর নিয়ে নিসে। আমাকে আর কেউ ভালবাসবে না। কাল সবাই বলেছে এখন সবাই ভাইকে ভালোবাসবে
আমি বড় হয়ে গেসি আমাকে কেউ আদর দিবে না।
ভিডিওর কথা তখন শেষ তবে ভিডিও টা চলছে। পুতুল টা পড়ে আছে রিয়া নেই। সিলিং এ ফ্যান টা চলছে,মৃদু স্বরে টিভিতে কার্টুনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।৷
পুরো পরিবেশ একদম নিঃশব্দ। মেহেরুন চাচী একজন শুধু অনুতাপে নেই, কম বেশি আমরা সবাই এইধরণে কথা ছোট বাচ্চাদের কে বলে থাকি। সেদিন সবাই হাসাহাসি করেছে রিয়াকে এইসব কথা বলে।
চাচী আমতা করে বলল, এমন দুষ্টমী তো সবার সাথেই করি, কেউ তো কখনো এমন কিছু করে নি। তোর মেয়ে -
নিশি রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে তাকালো,
- সব বাচ্চাই কষ্ট পায় এইধরনের কথায়। কেউ কম কেই বেশি। তবে এই জিনিস টা রয়ে যায় অনেক বছর। সব বাচ্চা তো এক না।
ছোট বাচ্চা হলে সে ঘরের বড় বাচ্চাটাকে আমরা সবাই এইধরণের কথা মজার ছলে বলে থাকি। একবার ভাবি না যে এতদিন মা বাবার মধ্যমণি ছিলো হঠাৎ করে তার প্রতি মমনোযোগ কমে যাওয়াটা হয়ত স্বাভাবিক কিন্তু তার সামনে এই ছোট্ট বাচ্চাদের মনে এই ধরণের কথা ঢুকানোর আগে একবার চিন্তা করি না ছোট্ট মনে কি প্রভাব ফেলে।
কেউ কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিশি ফোন বেজে উঠলো, আরিফের ফোন।
- বাচ্চাদের অবস্থা বেশি সিরিয়াস তাড়াতাড়ি আসো।
নিশি দ্রুত উঠে যায়, ওর মা আর চাচীরা যেতে চাইলে নিশি হুংকার দিয়ে উঠে,
-কেউ আসবে না তোমরা। তোমরা সবাই আমার বাচ্চাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী। সবাই-
বলতে বলতে বাম হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আর আমরা সবাই নিঃশব্দে একটা একটা থাপ্পড় খেয়ে বসে রইলাম যারা যারা একবার হলেও এই ধরনে নিম্ম মানসিকতার মজা করেছি বাচ্চাদের সাথে।
-থাপ্পড়
-দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা