চাপা কষ্টের স্ট্যাটাস
বিয়ের মাস দুয়েক পরে শশুর মশাই আমাদের দু'জনকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। বাড়ির বউ পড়াশোনার নাম করে রোজ রোজ বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াবে এটা উনার পছন্দ নয়। মেয়েদের মন থাকবে সংসারে, ঘরের কাজকর্ম করবে, স্বামীর যত্ন নিবে। তা না করে পড়াশোনার নামে পিঠে উপর ব্যাগ ঝুলিয়ে দিন-রাত টোটো করে ঘুরে বেড়ানোর কোন মানে হয় না। তবে আমার স্বামী কখনো শশুরের মতো চিন্তা করেনি। বাসর রাতে হাত ধরে বলেছিলো, " তুমি পড়তে চাইলে পড়তে পারো। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই, বরং আমি চেষ্টা করবো তোমার পাশে থাকতে। তোমার ইচ্ছা-আনিচ্ছাগুলো সম্মান জানাতে। এই ব্যাপার নিয়েই শশুরের সাথে ঝামেলা। এক পর্যায়ে উনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, " বউকে পড়াতে হলে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পড়াও। আমার বাড়িতে এসব চলবে না। "
স্বামী অবশ্য বাবার মুখের উপর কিছু বলেনি। আমার কাছে এসে কোমল গলায় বললো, " বাবা আগের দিনের মানুষ। বুঝতেই তো পারছো। আমরা না হয় কিছুদিন ভাড়ার বাসায় থাকলাম। পরে আব্বা বুঝিয়ে আবার ফিরে আসবো। "
" এসবের কি দরকার? "
" কখনো কখনো নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে হয়। যে পাশে থাকার ওয়াদা দেয়, তাকেও পাশে থাকতে হয়। বুঝতে পারলে?"
প্রতিত্তোরে কিছু বলিনি। বাবাকে বলেছিলাম শশুর আব্বুকে একটু বুঝিয়ে বলতে। বাবা বলেছে, " এতো পড়াশোনার দরকার কি? জামাই খুব ভালো চাকরি করে, মোটা অংকের বেতন পায়। তাছাড়া তুই খুব ভালো ছাত্রী না, টেনেটুনে ৪.০০ পেয়েছিল এইচএসসি তে। এমন রেজাল্ট নিয়ে এ বাজারে চাকরি পাওয়া মুশকিল। এর থেকে ভালো হয় মন দিয়ে সংসার করলে। অযথা পড়াশোনা করে কি হবে!"
বাবার কথার অর্থ বুঝতে পারিনি। মন থেকে এসব বলেছে নাকি শশুরের কাছে তার কথায় দাম নেই। হয়তো মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে বাবার অধিকারও কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে। মা'য়েরও এক কথা, পড়াশোনা করে কি হবে! সংসারে বাড়তি অশান্তি। এর থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পড়াশোনা ছেড়ে দেবো। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে পারলাম না। লোকটা কেমন একগুঁয়ে স্বভাবের। একবার সিদ্ধান্ত নিলেই হলো, তার কথার নড়চড় হবে না।
সবকিছু মিলিয়ে বিয়ের দুমাসের মাথায় ঘর ছাড়া হলাম। অল্প ভাড়ার মধ্যে দু' কামরার একটা বাসা ভাড়া নিলাম। সেখানেই টোনাটুনির সংসার শুরু। ভাড়ার বাসায় প্রথম দিন কোন প্রকার আসবাবপত্র ছিল না। রাতে শোবার মতো খাট ছিলো না। মেঝেতে চাদর বিছিয়ে দু'জনের শোবার ব্যবস্থা হয়েছিলো। পরনের কাপড় পেঁচিয়ে একটা মাত্র বালিশ, সেই বালিশ ভাগাভাগি করে রাত কাটিয়েছি। আমি অবশ্য বেশিরভাগ সময় ওর হাতের উপর শুয়ে ছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমায় চোখ মেলতে দেখতে গভীর আবেগে বললো, " দু'জনে এভাবে মানিয়ে নিলে একসাথে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো, তাই না বলো? "
প্রতিত্তোরে মুচকি হেসেছিলাম। উনার বিষয়টা পছন্দ হয়নি। দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করেছে। জোর গলায় বলেছি, " হ্যাঁ, অবশ্যই পারবো। "
আজ বিয়ের ছ’বছর পর হলো। পড়াশোনা শেষ করেছি বেশ কিছু দিন হলো। ভাগ্য ক্রমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকতা করি। ছয় বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভাড়ার বাসা ছেড়ে শশুর বাড়িতে গিয়ে উঠেছি। আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু নাজিমের দিকে তাকিয়ে না করতে পারলাম না। ছেলেটা বড্ড শখ মা বাবার সাথে এক ছাঁদের নিচে থাকবে। অথচ এই লোক সেদিন জেদ করে আমার হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলো। শশুর নিজে এসে আমাদের ও বাড়িতে নিয়ে গেছিলো। হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। মা-বাবাও অনেক খুশি, বেশিরভাগ সময় নাজিমের প্রশংসায় মেতে থাকেন। এমন জামাই পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! সবাই পরিবর্তন হলেও নাজিমের কোন পরিবর্তন হয়নি। লোকটা আজও আমায় আগের মতো ভালোবাসে।
স্কুলের সামনে শিউলি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে অনেক কথা ভাবছি। নাজিম পাশে না থাকলে বোধহয় আমিও শিউলি ফুলের মতো ঝরে যেতাম। হয়তো কিছুক্ষণের জন্য সকলের প্রিয় হয়ে উঠতাম কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব বিলিন হয়ে যেত। সুখী হলেও তৃপ্তি মিটতো না। কোথাও না কোথাও আফসোসের ছাপ রয়ে যেত।
এমন সময় সাদিক স্যার আমার দিকে এগিয়ে এলেন। একসাথে চাকরি করি, সবে একমাত্র হলো উনি এখানে জয়েন করেছেন। কাছে এসে বিনম্র গলায় বললেন, " অনেকদিন ধরে আপনাকে একটা কথা বলবো বলবো করছি কিন্তু বলা হয়ে উঠছে না। "
" জ্বি বলুন, কি বলতে চান? "
" আসলে আপনাকে আমার ভালো লাগে। জানি আপনি বিবাহিত। তবে কেন যেন মনে হয় আপনি নিজের বিবাহিত জীবনে সুখী নয়। আপনার স্বামী বোধহয় আপনাকে তেমন একটা ভালোবাসে না। "
" এ কথা মনে হওয়ার কারণ? "
" আপনার মাঝে কোন শখ - আহ্লাদ নেই। জীবনে ভালোবাসা থাকলে মেয়েদের এমন অবস্থা হয় না। "
" ভুল বললেন সাদিক ভাই। বোরকা হিজাব পরে অফিসের এক কোণায় বসে থাকি বলে আমাকে অসুখী ভাবার প্রয়োজন নেই। "
" কি বলতে চান? স্বামীর সঙ্গে অনেক সুখে আছেন?"
" সুখে আছি কি-না জানি না। তবে আমার জীবনে এমন একজন মানুষ আছে, যাকে ছ'বছর ধরে পাশে পেয়েছি। যে মানুষটা শত ভুল ক্ষমা করে দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরার অপেক্ষা করে। জীবনে এমন কেউ কখনোই আসবে না যার জন্য ওই মানুষটা ছেড়ে দেওয়া যায়। "
" একটু বেশিই বলেছেন না? "
" না সাদিক ভাই। একদমই না। কাউকে ভালো লাগা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু কারো প্রিয়জন নিয়ে বাজে মন্তব্য করা অতন্ত্য জ'ঘ'ন্য কাজ! মাফ করবেন। "
সাদিক ভাই কিছু না বলে উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো। একটা রিকশা ডেকে আমিও বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম। নাজিম হয়তো একক্ষণে বাড়ি চলে এসেছে, তাড়াতাড়ি ফেরা প্রয়োজন। আমায় না দেখলে নাকি তার ভালো লাগে না!
সমাপ্ত
-পূর্ণতা
কলমে : ফারহানা_কবীর_মানা