চতুর্থ পর্ব ও শেষ: নতুন ভোরের গল্প
স্ত্রী ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। চোখে অনুশোচনার অশ্রু। স্বামী তার সামনে বসে শুধু তাকিয়ে আছে। কোনো শব্দ নেই, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুজনের মাঝে কিছুটা নীরবতা, যেন দুইটি হৃদয় নিজেদের ব্যথা অনুভব করতে চাইছে, কথা নয়– অনুভবই তাদের ভাষা।
স্বামী শান্ত কণ্ঠে বললো:
"তুমি জানো, আমি এতটা ভেঙে পড়েছিলাম তোমার চলে যাওয়ায়, আমি মরে যেতে চেয়েছিলাম। আমি ভাবিনি, তুমি ফিরে আসবে। কিন্তু আজ যখন তোমাকে এখানে দেখি, মনে হলো বোধহয় এখনও কিছু বাকি আছে... কিছু বাঁচিয়ে রাখা যায়..."
স্ত্রী নিচু গলায় উত্তর দিলো, "আমি ভুল করেছি। ভীষণ ভুল। আমি বুঝতে পারিনি, আপনি কতোটা ভালো একজন মানুষ। আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিলাম এক মিথ্যার পেছনে, ভালোবাসার নামে এক অভিনয়ের পেছনে... কিন্তু আজ আমি চোখ খুলে বুঝতে পেরেছি – আপনি ছাড়া আমার জীবনে কেউ নেই।"
স্বামী: "তুমি জানো, আমি তোমার দেওয়া ডিভোর্স পেপারে সাইন করিনি। কোর্ট থেকে যখন নোটিশ এলো, আমি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, হয়তো তুমি একদিন ফিরে আসবে... আর আমি তখন যেন তোমাকে ফিরিয়ে না দেই, এটা আমার হৃদয় সইতে পারবে না।"
স্ত্রী হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, দৌড়ে গিয়ে স্বামীর পায়ে পড়ে গেলো।
"আমি ভুল করেছি, আমাকে মাফ করে দিন। আপনার পায়ের নিচে পড়ে বলছি, আমাকে আর দূরে পাঠাবেন না। আমি বাকি জীবন আপনার পাশে থেকে, আপনার সেবা করে কাটিয়ে দিতে চাই।"
স্বামী স্ত্রীর মাথায় হাত রাখলো। কণ্ঠটা কাঁপছিল:
"আমার ভালোবাসা কখনো শর্তসাপেক্ষ ছিল না। তুমি যত ভুলই করো, আমি চাই তোমাকে শুধরে নিতে। ফিরে এসো, কিন্তু এবার তুমি যদি আবার কোনোদিন এই সম্পর্কের মর্যাদা ভাঙো, আমি হয়তো আবার উঠে দাঁড়াতে পারবো না।"
স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বললো:
"আমি আবার সেই মেয়েটা হবো না, আমি হবে সেই স্ত্রী–যে ছায়ার মতো আপনার সঙ্গে থাকবে, যত কষ্টই আসুক।"
তাদের কণ্ঠে আর কোনো শব্দ ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের গহীনে চলছিল নতুন গল্পের শুরু।
সেদিন দুপুরে একসাথে খাওয়া শেষ করে স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিল সেই ঘরে, যেখানে একসময় তাদের বাসর হয়েছিল। সেখানে স্ত্রীর চোখে এক চিলতে লজ্জা আর ভালোবাসার আলোর ঝলক।
স্বামী বললো:
"এই ঘরেই তুমি বলেছিলে, তুমি এখন প্রস্তুত নও... আমি তোমার সেই সম্মান রেখেছিলাম। আজ যদি তুমি মনে করো, আমরা নতুন করে শুরু করতে পারি, আমি রাজি আছি।"
স্ত্রী কিছু না বলেই তাকে জড়িয়ে ধরলো। এবার ভালোবাসা ছিলো নিঃস্বার্থ, নিষ্কলঙ্ক।
নতুন অধ্যায় শুরু
দুই মাস পেরিয়ে গেলো। স্ত্রী এখন পুরোপুরি বদলে গেছে। সে এখন শুধু একজন স্ত্রী নয়, সে একজন সহচর, বন্ধু, সহানুভূতিশীল জীবনসঙ্গী।
স্বামী আবার জীবনে ফিরে এসেছে, কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। আগের সেই প্রেমিকার সব ফাঁস হয়ে গিয়েছে সমাজে। তার প্রতারণার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হয়েছে।
একদিন স্বামী স্ত্রীর হাতে একটা ছোট বাক্স দিলো। স্ত্রী খুলে দেখে একটা সোনার চেইন, সঙ্গে ছোট্ট একটা চিঠি।
চিঠিতে লেখা ছিল:
"আমার পৃথিবীতে তুমি ছাড়া কিছু ছিল না, নেই, আর থাকবেও না। তুমি ফিরে এসেছো, এখন আমার জীবন আবার পূর্ণ হয়েছে। এই চেইন কোনো অলংকার নয়, এটা আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি – আমি সব ভুলে, তোমার পাশে থাকবো, আজীবন..."
স্ত্রীর চোখ বেয়ে আবারও অশ্রু গড়িয়ে পড়ে... তবে এবার সেই অশ্রু কষ্টের নয়, ভালোবাসার।
শেষ দৃশ্য
এক সন্ধ্যায় দু’জন ছাদে দাঁড়িয়ে সূর্য ডুবছে দেখছে। স্বামী স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললো,
"তুমি তো বলেছিলে, আমার মতো মানুষ পৃথিবীতে আর নেই।"
স্ত্রী হেসে বললো,
"তখন বুঝিনি, এখন বুঝি – ভালোবাসা যার হৃদয়ে থাকে, সে-ই সবচেয়ে ধনী মানুষ। আমি এখন সবচেয়ে ধনী নারীর মতো নিজেকে মনে করি, কারণ আমি তোমাকে পেয়েছি।"
আকাশে তখন ঝলমলে তারা উঠতে শুরু করেছে। তাদের জীবনের আকাশেও জ্বলছে নতুন তারা – ভুল থেকে ফেরা এক ভালোবাসার তারা।
(সমাপ্ত)