গল্প: “চুপ করে থাকা ছেলেটি”
কবির ছিল একেবারেই সাধারণ জীবন। একটি ছোট গ্রামে তার বাড়ি, মা-বাবা, ছোট বোন—মোটেই কোনো বিলাসিতা নেই, কেবল প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বাবা দিনমজুর, মা বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালিয়ে সংসার সামলান। ছোট বোন—মিমি, মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে, চশমা পরা, বোকা-বোকা চেহারা। কবির তার এই ছোট পরিবারের জন্য নিজের সব স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছে।
সে জানে, তার বন্ধুরা কেউ কেউ শহরে গেছে, কেউ চাকরি পেয়েছে বিদেশে। কিন্তু সে রয়ে গেছে। কারণ তার বাবার ঘাড়ে ধার শোধের বোঝা, মায়ের ডায়াবেটিস, আর বোনের স্কুলের ফি—সব কিছু গায়ের উপর তুলে নিয়েছে কবির। দিনে মাঠে কাজ করে, রাতে গ্রামের এক চায়ের দোকানে বসে হিসেব রাখে। কখনো নিজের জন্য কিছু চায়নি।
একবার একটা সুযোগ এসেছিল। শহরের এক এনজিও ওকে বলেছিল, “তুমি চাইলে ঢাকায় গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে ভালো কিছু করতে পারো।” কবির শুধু বলেছিল,
“আমি গেলে, বাবার ওষুধ কে আনবে? মিমির বইয়ের টাকা কে দেবে?”
লোকেরা হাসে ওকে দেখে। বলে, “তুই কেনো সারাজীবন এই গাঁয়ে পড়ে থাকবি?”
কবির উত্তর দেয় না। শুধু চুপ করে থাকে।
কিন্তু একদিন বাবার ব্রেইন স্ট্রোক হলো। কবির রাত জেগে বাবাকে হাসপাতালের মেঝেতে ধরে বসে ছিল। মায়ের হাতে টাকা নেই, কবির পকেটে শেষ দশটা টাকা। ওষুধ কিনে এনে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বলল,
“বাঁচো, বাবা। আমি না থাকলে তোমরা কী করবা?”
বাবা তখনও কথা বলতে পারে না, কিন্তু চোখে জল আসে।
সেই জলই কবির জীবনের সবচেয়ে দামি স্বীকৃতি।
মিমি এখন ক্লাস এইটে। ভালো রেজাল্ট করে। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া, তুমি কি কখনো তোমার মতো করে বাঁচতে চাও না?”
কবির মুচকি হাসে।
“আমি আমার মতোই তো বাঁচছি, মিমি। তোমাদের মুখে হাসি থাকলে, সেটাই আমার জীবন।”
একদিন মিমি শহরে পড়তে যাবে, মা একটু সুস্থ হয়ে উঠবেন—এই স্বপ্নই কবিরের নীরব প্রেরণা। সে চায় না কেউ তার গল্প জানুক। সে শুধু চায়, কেউ যেন কষ্ট না পায় তার জন্য।
তাই সে চুপ করে থাকে।
কারণ সব ছেলেরা শব্দ দিয়ে কষ্ট বোঝায় না—কেউ কেউ চুপ থেকেও ভালোবাসে।