স্বামী স্ত্রীর কষ্টের গল্প
আমার স্ত্রীকে বলতে ইচ্ছা হতো,
- 'মিলি,একটা বাচ্চা হলে বেশ হয়।ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।'
বলতে চেয়েও বলতে পারতাম না।
সঙ্কোচ হত। খুব ছোট্ট কারণে চিৎকার চেঁচামেচি করা ওর স্বভাব।রাগতেও সময় লাগে না, রাগ ভাঙতেও সময় লাগে না।বিয়ের পর মিলির সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। সারাদিন সবার সাথে বেশ থাকে। নতুন বৌয়ের সাথে ভাবী, দুলাভাইরা ঠাট্টা-মশকরা করবে এইতো স্বাভাবিক। মিলি মানতে পারত না। রুমে এসে ফোঁসফোঁস করতো।
- 'এত কুৎসিত কথা মানুষ বলে কি করে?'
- 'আহ! কি হয়েছে বলবা তো।'
- 'বলবো না।'
- 'তাহলে অর্ধেক কথা বললে কেন?'
মিলি উত্তর দিত না। বালিশ নিয়ে সোফাতে শুয়ে পড়তো।
.
ওর স্বভাব ভীষণ অগোছালো।দুএকটা উদাহরণ দেই, ঘুরতে যাবার সময় মিলি কখনও শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ খুঁজে পেত না। সবুজ শাড়ির সাথে ম্যাটমেটে খয়েরি ব্লাউজ নিদ্বির্ধায় গায়ে চড়াত। এমনিতে সাজতে পছন্দ করত না। চুল আঁচড়ে সামান্য ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষতে আধঘণ্টা লাগাত।
- 'সাজো না এতেই এত সময় লাগে।সাজলে কি হত?'
মিলি মুখ ঘুরিয়ে রাগ করতো। ওর সবকিছুর মত রাগটাও ভীষণ উপভোগ করতাম।
.
বিয়ের আড়াই বছর পর মিলি কনসিভ করলো। প্রচণ্ড খুশি হলাম। ও জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার আমাকে দিতে যাচ্ছে। মিলির সাথে এ আনন্দ ভাগ করা যেত না। রগচটা স্বভাবের ধার প্রেগন্যান্সির সময় আরো বাড়লো।
- 'তুমি কাকে বেশি ভালোবাসবে? বেবিকে না আমাকে?'
- 'সমান সমান।'
- 'অ্যাবোরেশন করে ফেলবো।'
- 'কি বলছো?'
- 'তুমি কেন ওকে আমার সমান ভালোবাসবে? কেন বাসবে?'
আঁচড়ে কামড়ে একাকার করে ফেলতো। ওকে সামাল দিতে আমার বেগ পেতে হতো।
রাত হলে বায়না ধরতো,
- 'পেটে হাত দাও।'
- 'দিচ্ছি।'
- 'দিচ্ছি না এখুনি দাও।'
- 'আচ্ছা।'
- 'আমার একটা ছেলে হবে।'
- 'আল্লাহপাক খুশি হয়ে যা দেন।'
- 'মেয়ে হলে আমি কোলে নিব না।'
- 'কিসব বলো।'
- 'সত্য বলি।'
কি উত্তর দিব ভেবে পেতাম না। একটুপর আবার বলতো,
- 'কার মতো হবে?'
- 'বেবিরা বাবার মতই হয়।'
- 'উহু! আমার মত চুল হবে,চোখ হবে,নাক হবে এমন ঝগড়াটে হবে।'
- 'আচ্ছা।এবার ঘুমাও।'
খানিকপর জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখত।ফিসফিস করে বলতো,
- 'তোমার মতই হবে। তোমায় স্পর্শ করলে যেমন তৃপ্তি আসে ওকে ছুঁয়ে আমি তেমন সুখ পাবো।'
.
ব্যবসায়িক কাজে বাইরে থাকতে হত প্রচুর। তবু চেষ্টা করতাম বাড়িতে একবেলা সবার সাথে খাবার টেবিলে বসতে। মিলি এত্ত পাগল আধঘণ্টা না যেতেই ফোন দিতো,
- 'কই তুমি? এখুনি আসো।'
- 'মাত্র গেলাম।লেট হবে।'
- 'তুমি আসবা নাকি আসবা না?'
.
দিন যায় ওর পাগলামি বাড়ে। চিটাগাং ছিলাম পনেরদিন। রোজ রাতে ফোন দেই,
- 'কি করো?'
- 'হাঁটছি।'
- 'ঘুমাবে না?'
- 'ঘুম পাচ্ছে না।'
- "ঘুমানোর চেষ্টা করো।'
- 'খবরদার আমার উপর মাতাব্বরী করতে আসবে না। কে হও তুমি আমার?'
যত শান্ত করার চেষ্টা করি রাগ তত বাড়ে।
শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বলি,
- 'রাখছি ফোন। কাজ আছে।'
- 'যাবে না তুমি।'
- 'কি করবো?'
- 'আমায় বুকে নিয়ে বসে থাকবে। এখুনি নাও।'
---
---------
---------------
শৈশবের জন্মের পর পাগলি মেয়েটা কখনও বায়না ধরে না বুকে নাও। শৈশবের মাথার কোঁকড়া চুল থেকে পায়ের কড়ে আঙুল পর্যন্ত হুবুহু আমার কার্বন কপি। শুধু স্বভাবটা মায়ের। স্কুলে যাবে ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছি,
- 'আব্বু, আইসক্রিম খাবো।'
- 'আচ্ছা।'
- 'ফ্রেঞ্চফ্রাই।'
- 'হুম।'
- 'তারপর, চকলেট, চিকেন রোল, ঝালমুড়ি।'
- 'সব পাবে, নাও জুতা পরো।'
.
রাতে ঘুমানোর সময় গলা জড়িয়ে ধরে,
- 'আব্বু, মামনি কতদিন আমাদের সাথে নেই?'
- 'দু'তিন মাস।'
- 'অনেকদিন, তাই না?'
- 'বেশিদিন না। এসে পড়বে। এখন ঘুমাও।'
ছেলে কোলবালিশে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি পিছন থেকে ছোট্ট শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে রাখি।
শৈশবকে বকতে পারতাম না।রাগী চোখে তাকালে শার্টের হাতায় চোখ মুছত।
কোন এক শনিবারে একটা ধমক দিয়েছিলাম সে কথা মনে পড়ে আরো বেশি করে কাঁদত। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর মার কথা মনে পড়ত। বিয়ের দু'বছর পর বাড়ি ফিরে দেখি কাঁদছে।
- 'কাঁদছ কেন?'
- 'কি করছো তুমি? মনে নাই?'
- 'কি করলাম?'
- 'বিয়ের ঠিক ১০ দিনের মাথায় তুমি বলছে কি,আমাকে বিয়ে করা তোমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।বলো নাই?'
- 'হায়রে! এত আগের কথা মনে থাকে নাকি?'
- 'আমার থাকে।সরো তুমি। ছুঁবে না আমায়।'
শৈশব ঠিক মায়ের মত ভঙ্গী করে কাঁদছে।কবে দুধ খাবার সময় গালি দিয়েছিলাম সে কথা মনে পড়েছে।
কলিংবেল বাজল। চোখ মুছে উজ্জ্বল মুখে বললো,
- 'আব্বু,মামনি এসেছে।'
- 'আজ তো আসার কথা নয়। অন্য কেউ।'
শৈশব তবু খুব আগ্রহ নিয়ে দরজা খুললো।
রাশেদ সাহেব। লতায় পাতায় মায়ের আত্মীয় হন।
- 'আপনার ছেলে বোধহয় আমাকে দেখে খুশি হয় নি।গোমড়া মুখে ভিতরে চলে গেল।'
- 'ও মনে করেছিল ওর মা এসেছে।'
- 'ওহ আচ্ছা। ভাবী কি বাইরে গেছেন?'
- 'ওর মা মারা গেছে কিছুদিন আগে।'
ভদ্রলোক নিশ্চুপ।ধাতস্থ হতে কিছু সময় নিলেন,
- 'আই অ্যাম সরি।'
- 'না, ঠিক আছে।'
- 'কতদিন হল ভাবী মারা গেছেন?'
- 'বেশি না পাঁচ বছর কয়েকমাস।'
(সমাপ্ত)...
অণুগল্প || দীপ্তিহীন
লেখা || হাবিবা সরকার হিলা
------------------------------------