রহস্যময় ঘটনা
আমার প্রেগন্যান্ট স্ত্রীর চিৎকারে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম।
হটাৎ তার এমন ভয়ার্ত চিৎকার আমাকেই ভয় পাইয়ে দিয়েছে।এদিকে বিছানায় সে গড়াগড়ি করে যাচ্ছে। বুঝে যাই বাচ্চা প্রসবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই মুহুর্তে তাকে নিয়ে আমি যাবো কোথায়। বাহিরে বিজলী চমকাচ্ছে। তার উপর আবার আশেপাশে ধাত্রী পাবো না। যেতে হবে প্রায় ৩ কিলোমিটার, হাসপাতালে পৌঁছাতে হলে। রাস্তার অবস্থাও ভালো নয়। মাটির কাচা রাস্তা। তার মধ্যে আবার গত ৪ দিন যাবদ বৃষ্টি হচ্ছে। পিচ্ছিল হয়ে আছে সব। এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে, হসপিটাল পর্যন্ত আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া মুশকিল। কিন্তু কি বা করার আছে। যেতে তো হবেই।
৪ দিন ধরে ঝড় তুফানে কারেন্টও নেই। বাজার থেকে ৯০০ টাকা দিয়ে কেনা বাটন ফোন কবেই বন্ধ হলো। কাওকে যে কল করে সাহায্য চাইবো। সেই পন্থাটাও নেই। আমি একজন ভ্যান-চালক। আমার এই ভ্যানটাই এখন আমার একমাত্র ভরসা।
স্ত্রীকে কোনোভাবে কোলে নিয়ে দরজার কাছে এলাম। বাড়িটা নতুন বাড়ি। কদিন হলো এই জমিনে ঘর করলাম। এখনো সব এলোমেলো। আশেপাশে ঘর বাড়িও নেই। যেগুলা আছে,সেসবে যেতে ২-৩ মিনিটের মতো লাগবে। উপায়ন্তর না পেয়ে স্ত্রীকে ভ্যানে শুয়ে দিয়েছি। সে তো চিৎকার করেই যাচ্ছে। আমি জানিনা এই সময়ে মেয়েদের ব্যাথা কেমন হয়। তবে আমি উপলব্ধি করতে পারি,অনেক বেশিই ব্যাথা হয়তো।
সাদা পলিথিনের তেরপাল বউয়ের উপরে ঢেকে দিলাম। যাতে বৃষ্টির পানি না পড়ে। এদিকে বৃষ্টির গতি বেড়ে যাচ্ছে। তার উপর বিজলী যেনো আমার জন্যেই চমকাচ্ছে আজ। আল্লাহর নাম নিয়ে ছুটতে লাগলাম হসপিটালের দিকে।
আমার কাছে আলোর কোনো ব্যবস্থা নেই। টর্চ লাইট টাও বন্ধ হয়েছে পরশু। বাসায় মোমবাতির আলোয় কাটছে দিন। কিন্তু এই বৃষ্টিতে তো মোমবাতি নিয়ে বের হওয়া সম্ভব নয়। তাই বিজলীর আলোয় যেটুকু দেখা যায়,সেটির উপর নির্ভর করে এগিয়ে যাচ্ছি।
রাস্তায় জমে থাকা কাদায় ভ্যানের চাকা আটকে যাচ্ছে বার বার। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে ভ্যান টেনে নিচ্ছি। এদিকে আমার স্ত্রীর চিৎকার সহ্য করতে পারছিলাম না। ডেলিভারির আরো ১ মাস সময় ছিলো। এতো দ্রুত কিভাবে হচ্ছে তাও জানিনা। মাথায় সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে,আর আমি এগিয়ে যাচ্ছি হসপিটালের দিকে।
পলিথিনের তেরপাল স্ত্রীর উপরে থাকলেও, সে ভিজেই যাচ্ছে। আমার দেহ বেয়ে ঘাম আর বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ছে। এ যেনো কঠিন এক পরিক্ষায় পড়লাম আমি। না পারতেছি উল্টো ফিরে যেতে। আবার না পারছি সামনের দিকে আগাতে। পরিস্থিতি এতোই কঠোর হয়ে গিয়েছিলো,যে কেও আমার স্থানে থাকলে একই গোলকধাঁধায় পড়তেন।
বহু কষ্টে তুফানের বাতাস আর বৃষ্টির বাধা পেরিয়ে মাঝরাস্তায় এসেছি। আরো আধা কিলো পথ বাকি। এই রাস্তাটার বিবরণ না দিলেই নয়। রাস্তা ঘুরেফিরে মাটির কাচা রাস্তা। এক পাশে একটা বিশাল পুকুর। অন্য পাশে বিশাল এক বাঁশঝাড়। এই অব্দি এসে আমি আটকে যাই। বাম পাশের বিশাল বাঁশঝাড় ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে আছে। আর ডান পাশে পুকুর। একে তো পিচ্ছিল রাস্তা। তার উপর পুকুরের কিনারা বেয়ে গেলে যদি ভ্যানের চাকা পুকুরের দিকে চলতে শুরু করে। তবে ভ্যান সহ আমার স্ত্রী পুকুরে পড়ে যাবে। এদিকে বউয়ের চিৎকার থামছেই না। তার প্রসবের যন্ত্রণা হয়তো ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছিলো। আমি ভ্যান রেখে দৌড়ে যাই সামনের দিকে। দুয়েকটা বাঁশ সোজা করলেও,বড় বাঁশ গাছটা সরাতে পারছিলাম না। নিজের যা শক্তি আছে, সবটা দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। এদিকে বউয়ের চিৎকার আমাকে ক্রমাগত ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।
ভাগ্য ভালো ছিলো আমার।আল্লাহ সহায় হয়েছেন বলেই একটা লোক ছাতা আর টর্চ লাইট নিয়ে বেরিয়ে আসেন। লোকটার বাসা পুকুরের ওপাড়ে। আমার স্ত্রীর চিৎকার শুনে তিনি বের হয়ে এসেছেন। আমি লোকটাকে মিনতি করে বলি," স্যার,প্লিজ আমারে সাহায্য করেন। আমার বউডার অবস্থা বেশি ভালা না। হসপিটাল নিয়া যাইতে হইবো। স্যার প্লিজ।" লোকটা প্রভাবশালী ব্যক্তি। আমাদের বাজারে কমিটির সভাপতি। আমাকেও অনেক ভালো করে চিনেন। তিনি আবার উল্টো গিয়ে বাড়ি থেকে একটা দা নিয়ে আসেন।সেটি আমার হাতে দেওয়ার পর আমি বাঁশগুলা কেটে কেটে পুকুরে ফেলে দিচ্ছিলাম। মোটামুটি ভ্যান যাবার মতো রাস্তা করার পর আবার উনাকে দা ফিরিয়ে দিলাম। জয়নুল ভাই আমাকে তার হাতের টর্চ লাইট দিয়ে দিলেন। বললেন এইটা আমাকে রাখতে। আর সামনের এলাকায় কয়েকটা ছেলেকে তিনি কল করবেন। তারা আমার ভ্যান ঠেলতে সাহায্য করবে। আমি খুশিতে উনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। মাঝে মধ্যে আল্লাহ তার বান্দাদের দিয়েই আমাদের বিপদ সারিয়ে নেয়।
এরপর দৃশ্যটা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। আমার স্ত্রী ভ্যানে নেই। তুফানের গতি বেড়েছে তাই জয়নুল ভাই চলে গেছেন। আমি উনার পলিথিনে পেছানো টর্চ লাইটের আলো চারদিকে মেরে যাচ্ছি। স্ত্রী কোথায় আমার। ক্ষাণিক বাদে পলিথিন সহ স্ত্রীকে একটা বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায় দেখতে পেলাম।আমার চোখ কপালে উঠার অবস্থা। মনে হলো,বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে কেও আমার স্ত্রীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার দিয়ে আমি সেদিকে ছুটে যাই। দৌড়ার গতিতে অল্প একটু দেখেছি আমি। দুইটা জ্বলজ্বল করা চোখ বাঁশঝাড়ের পিছনে লুকিয়ে আছে। আমি আরো জোর গতিতে দৌড় লাগাই। কাঁদা মাটি আর ঝড় তুফান উপেক্ষা করে অবশেষে স্ত্রীর কাছে যাই। কিন্তু সেখানে যেয়ে আমি কাওকে দেখতে পাইনি। শুধুই আমার স্ত্রী অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। সেই মুহুর্তে বাঁশবনের উপর থেকে আমার চাচা নুরুল নবী ডাক দেন। আমি উপরে তাকিয়ে দেখি চাচা বাঁশ গাছে ঝুলে থেকে বলে," চলে যা তাড়াতাড়ি। তোর বউকে রেখে যা এখানে।" ধমকের স্বরে আমাকে কথাগুলা বললেন তিনি। আমি দাঁতে দাঁত কামড় মেরে স্ত্রীকে কোলে নিলাম। এরপর এক দৌড়ে ভ্যানের কাছে এসে,তাকে ভ্যানে শুইয়ে দিলাম। আবার রওনা করতে থাকি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
আমার চাচা মারা গেছেন ২০১৯ সালে। এখন ২০২২ সাল ( ঘটনা চলাকালীন সাল)। সে যে আমার চাচা নয়,তা অস্পষ্ট কিছুই না। ওটা কোনো বদজ্বীন বা আলগা বাতাস হবে। আমি দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে ভ্যান টেনে নিয়ে যাচ্ছি। আর এসব ভাবছি। এই মুহুর্তে আমার ভয় পাবার সময় নেই। আমার স্ত্রী আর বাচ্চাকে বাঁচানো মূল উদ্দেশ্য।
পরের এলাকায় প্রবেশ করার পর বাজারে দেখা হয় ৪ টা ছেলের সাথে। ওরা আমার কাছে এসে বলে," মোস্তফা ভাই ( ছদ্মনাম) । জয়নুল ভাই আমাদের বলেছে আপনি বিপদে পড়েছেন। চলেন হসপিটালে যাই।" ওরা সহ আমার ভ্যান ঠেলতে শুরু করে। আমি ওদের নিয়ে রওনা করি হাসপাতালের দিকে। আল্লাহ আমার সহায় ছিলেন বলেই এই মধ্য রাতে এতো লোকের সাহায্য পাচ্ছি। কিন্তু চিন্তা এখনো কমেনি। আমার বউ এখনো অজ্ঞান। হাসপাতালে কোনো খারাপ খবর না শুনলেই হলো। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আমি ভ্যান ঠেলেই যাচ্ছিলাম। পিছন থেকে রাকিব এসে বলে," মোস্তফা ভাই,আপনি পিছনে যান। ভ্যান আমার হাতে দিন।" আমি ওর হাতে ভ্যান দিয়ে স্ত্রীর কাছে যাই। বৃষ্টির পানি যেনো না পড়ে,তাই পলিথিনের তেরপাল দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলাম বার বার।
হাসপাতালে গিয়ে উঠেছি রাত ১ টার পর। হাসপাতাল বন্ধ। জয়নুল ভাইয়ের পাঠানো ছেলেগুলা দরজায় কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে। মিনিট ক্ষাণিক বাদে দুইজন নার্স বের হয়ে আসে। ওরা হাসপাতালেই থাকে রাতে। সবাই মিলে ধরাধরি করে আমার স্ত্রীকে ভিতরে নিয়ে যাই। একজন নার্স আমার স্ত্রীর চোখের পাতা তুলে বলে," ওর তো খুব বাজে অবস্থা। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।যাতে ভালো কিছুই হয়।" এ বলে মহিলাটি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যায় রুমে। ঐ ছেলেগুলা সহ আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি। আল্লাহর কাছে চাইতে চাইতে আমার কান্না এসে যায় প্রায়। সবার থেকে আড়ালে যাই,আর আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকি। বাহিরে তুফানে সব একাকার। সব মিলিয়ে গা ছমছমে পরিবেশ। সব কিছুর উর্ধে একটাই চাওয়া,আমার স্ত্রী সন্তানের মঙ্গল।
যেহেতু সবার থেকে একটা আলাদা স্থানে এসেছি। তাই জানালার বাহিরে থাকা হাসপাতালের সামনের জায়গাটা বুঝা যাচ্ছে। দোয়ার মাঝে আমার চোখ এক নজর সেদিকে যায়। আর আমি দেখতে পাই,আমার স্ত্রী ভ্যানে শুয়ে আছে এখনো। অবাক হলাম,ভিতরে কাকে আনলাম আমরা। নাকি বাহিরেরটা ভুল।
জানালার পাশ থেকে সরে আমি দরজা বরাবর যাই। দেখতে পাই,ভ্যান ফাঁকা। পূর্বের প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ বাহিরেরটা ভুল। এদিকে ছেলেগুলা আমার কাছে এসে বলে," কি মোস্তফা ভাই। বাহিরে এমন ঝড় তুফান হচ্ছে। জানালা আর দরজা খোলেন কেনো।বাতাস ঢুকতেছে প্রচুর। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আল্লাহর কাছে চান। ইনশাআল্লাহ্ ভালো কিছু হবে।" আমি ওদের কথায় বেশ অবাক হলাম। দরজা জানালা তো আগে থেকেই খোলা ছিলো। আমি কবে খুললাম। আবার মাথায় এলো বাতাসের ব্যাপারটা। এখন অনেক বাতাস,তাই আমার আমার গায়ে শীত শীত অনুভব হচ্ছে। কিন্তু একটু আগে দরজা খোলা থাকলেও এই বাতাস পাইনি। তবে আমিই খুলেছি দরজা? আলগা বাতাস ওটা কোনো আমার পিছু নেয়নি তো?
যদিও শুরু থেকে এই ব্যাপারটা আমলে কম নিয়েছি। আমার স্ত্রীর চিন্তা হচ্ছিলো শুধু। তবে এইবার এইটা আমলে না নিয়ে পারছিনা। কারণ আলগা বাতাস যদি আমার স্ত্রী এর উপর পড়ে। তবে তো বিরাট ক্ষতি। কোনোভাবে ওখান থেকে সরে এসে সিটে বসলাম। ছেলেগুলা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।
আধাঘণ্টা পর নার্স রুম থেকে বের হয়। আমার চোখে মুখে ভয়ের চাপ। জানিনা নার্স কি বলবে। তবুও বুকের একটা কোণায় ভয়ের ক্ষাদ রয়েছে। তবে আমার সব ভয় উড়িয়ে দিয়ে নার্স জানায়," আপনার একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে। বাচ্চা এবং মা দুজনেই সুস্থ।" আমি আলহামদুলিল্লাহ্ বলে আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া আদায় করি। খুশি হয়ে ভিতরে যাই। সন্তানকে কোলে নিয়ে এক নজর তাকাই। পুরো ওর মায়ের উপর গেছে। আমার বউয়ের চোখে পানি থাকলেও,মুখে মৃদু হাসি। কি ভাবছেন, শেষ ভালো যার সব ভালো টাইপের হয়েছে? নাহ, আমি ভাবতেও পারিনি। সেদিন থেকেই আমরা এক কালো অধ্যায়ের মধ্যে আটকে গেছি।
রাতে আর স্ত্রী কে বাড়িতে আনিনি। ঝড় তুফানের মধ্যে বের না হওয়াই ভালো। সারা রাত হসপিটালে ছিলাম। বাচ্চার জন্য গামছা আর কাপড় তো আনিনি। নার্সরা সেসবে সাহায্য করেছে আমাকে। ডাক্তারের বিল জয়নুল ভাই ছেলেদের মাধ্যমে পরিশোধ করেছে । এরকম মানুষ পাশে থাকলে,সত্যিই লোকেদের আর হতাশা থাকেনা।
পরেরদিন সকালে আমরা বের হই। ভ্যান বাজারে রেখে একটা সি এন জি নিয়ে বাড়িতে আসি। রাস্তার অবস্থা তেমন ভালো না এখনো। তবে সকাল থেকে কড়া রোদ। গতকাল রাতে সেই তুফান যেনো আমার জন্যেই এসেছে।
কেটে যায় ৩ দিন। সুন্দর ভাবে ৩ দিন পার হলেও। ৩ দিনের মাথায় রাতের বেলা ঘটতে শুরু হয় সব। আমার স্ত্রী বাচ্চাকে দুধ পান করাচ্ছে। আমি বাজার করার জন্য বাজারে গিয়েছিলাম। বউয়ের জন্য মাছ আর কিছু তরকারী নিয়েছি। এই ৩ দিন বাড়িতে অনেক মেহমান এসেছে। আজ মোটামুটি গা পাতলা হলো। বউ এমনিই অসুস্থ। তার উপর মেহমানের সামনে সুস্থতার ভান ধরা। কাজ না করলেও অনেক ধখল গিয়েছে। বাজার শেষে বাড়ির দিকে এসে দেখি,স্ত্রী উঠোনে বসে আছে। আমার বউয়ের চারপাশে অনেক মহিলাও আছে। আমি বাজারের ব্যাগ ফেলে দৌড়ে যাই স্ত্রীর কাছে। সে আমাকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম মূল ব্যাপার কি। বউ কান্না করতে করতে বলে," সন্ধায় আপনি বাজারের দিকে গেলেন। আমি তানিয়াকে দুধ পান করাচ্ছিলাম। আবার ৫ মিনিট না যেতেই আপনি ফিরে এসেছেন। আমি ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞেস করেছি,কিন্তু আপনি কোনো উত্তর দেন নি। সোজা এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কয়েকবার আমার প্রশ্ন শুনে আপনি রেগে এসে তানিয়াকে কেড়ে নিয়েছেন। এরপর এক দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি অসুস্থ শরীর নিয়েও ছুটে আসি। দরজায় এসে দেখি একটা বুড়ি মহিলা তানিয়াকে উঠোনে ফেলে দেয়। এরপর তানিয়ার গলায় এক লাথি মেরে দিয়ে হত্যা করে। আমি চিৎকার দিতেই বুড়ি মহিলা তানিয়াকে নিয়ে বিলের দিকে দৌড় দেয়।ওটা সাধারণ দৌড় ছিলো না। যেনো বাতাসের গতিতে চলে গেছে। এরপর আমার চিৎকারে সবাই ছুটে এলো। আমার বাচ্চাকে আলগা বাতাস নিয়ে গেছে। আমার সব শেষ হয়ে গেলো।"
বউয়ের মুখে পুরোটা শুনে আমার হুশ উড়ে যায়। চোখের কোণায় এক ফোটা পানি জমে এলেও তা মুছে নিয়েছি। আমার সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিলো। ঝড়ের রাতে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। সেটিকে পাত্তা না দেওয়া অনেক বড় ভুল করে ফেললাম। বউকে উঠোনে রেখে কয়েকজন লোক নিয়ে গেলাম বিলের দিকে। লাইট মেরে অনেক খোঁজাখুজির পর তানিয়াকে পেয়েছি। অনেক বিশ্রী ভাবে হত্যা করেছে। আমার মেয়ের দেহটাই পেয়েছি শুধু। দেহে কোনো মাথা নেই।
বাচ্চার দেহ নিয়ে চলে আসি বাড়িতে। হুজুর ডেকে জানাযা শেষ করে কবর দিয়ে আসি। এ যাত্রায় হেরে যাই। মনকে মানিয়ে নিলাম,আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। হয়তো আরো বড় কিছু হতে পারতো।কিন্তু সন্তান হারানোর কষ্ট তো আর সহজে ভুলা যায়না। এটি থেকে বের হতে আমাদের অনেকদিন লেগে গেছে । আমার স্ত্রী তানিয়ার শোকে বহুদিন মনমরা ছিলো। তবুও কিছুটা স্থীর হয়ে আমরা পরবর্তী সন্তান নেবার সিদ্ধান্তে আসি।
আমি সাধারণ একজন ভ্যান-চালক। আমার তেমন কোনো শক্তি নেই। আল্লাহর উপর ভরসা করে দিন এনে দিন খাই। গতবারের পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতেই আমার অনেকদিন লেগে গেছে। শুধু মানসিক তো না। আর্থিক দিক থেকেও শক্তি লাগে। স্ত্রীর অসুস্থতা, তানিয়ার মিলাদ এসবে খরচ হওয়া টাকা অন্যদের কাছে সামান্য টাকা লাগলেও, আমার কাছে সেসব কামাই করা মর্মপীড়া। সব কিছুর পরেও সিদ্ধান্ত নিলাম,আরো একটি বাচ্চা নিবো।
দীর্ঘ ৬ মাস পর সিদ্ধান্তে শামিল হই আমরা। আল্লাহর রহমতে আমার স্ত্রী আবারো গর্ভবতী হয়। ডাক্তারের মুখে পজিটিভ এসেছে জেনে,দ্বিতীয় বারের মতো খুশি হই দুজনেই। পুরোনো সব কিছু ভুলে গিয়ে,আবারো নতুন স্বপ্নের আশা বেধেছি। আমার স্ত্রী যখন ৪ মাসের গর্ভবতী। সেদিন রাত ১১ টায় বাজারের সভাপতি আমাকে কল দেন। জয়নুল ভাইয়ের কল পেয়ে তড়িঘড়ি করে রিসিভ করি। ঢাকা থেকে উনার কিছু ফার্নিচার মাল এসেছে। ট্রাক বাজারের পর এক কিলো আসতে পারবে। পরের রাস্তাটা ভাঙ্গা তাই ট্রাক ঢুকবে না। আমি ভ্যানে করে সেসব উনার বাড়ি অব্দি নিতে পারবো কিনা জিজ্ঞাসা করেন। আমি পারবো,সম্মতি জানানোর পর তিনি বলেন সকালে যেতে। রাতে সবটা দোকানে রেখে দিবে। মানবতার খাতিরে আমি এখনি নিয়ে আসবো বলি। জয়নুল ভাই খুশি হয়ে বলেন," ঠিক আছে।নিয়ে আসেন। আপনাকে বখশিশ করবো আমি।" আমিও খুশি হয়ে যাই। রাত ১১ টায় ভ্যান নিয়ে বের হই উনার মালপত্র নিয়ে আসতে।
ঐ স্থানে যেতে যেতে বেজে যায় রাত সাড়ে ১১ টা। শীতকালের সময়টা তখন। আমি কুয়াশা ভেদ করে ঐ স্থানে উপস্থিত হই। সেখানে জয়নুল ভাই সহ কয়েকজন ছিলেন। ট্রাক থেকে সোফা আর কিছু ভিন্ন ফার্নিচার ভ্যানে তোলা হয় আমার। আমি সেগুলা জয়নুল ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে যাই। আবার এসে বাকিগুলাও নিয়ে নিলাম। মোট ৩ বারে সব মাল নিয়ে যেতে হয়েছে। জয়নুল ভাই আমাকে খুশি হয়ে ২ এর স্থানে ৪ হাজার টাকা দেন। আমি যেনো খুশিতে আবারো উনাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছি। আমার চেহারা দেখে তিনি বলেন," যান। আর ভাবিকে আমার সালাম জানাবেন। এইবার ছেলে নাকি মেয়ে হবে?" আমি লাজুক চাহনিতে তাকিয়ে বললাম," আল্লাহর উপর ভরসা। তিনি যা দিবেন,তাতেই আমি সন্তুষ্ট।" জয়নুল ভাই মুচকি হাসলেন। আমি ভ্যান নিয়ে আবার চলে এলাম নিজের বাড়ির দিকে।
যখন বাড়ির গেটে ঢুকবো,একি দৃশ্য দেখলাম আমি। আমার স্ত্রী উঠোনে বসে বসে কান্না করছে।আর আমার স্ত্রীর পাশে অনেক লোক।
আমি কিছুই বুঝিনি। মুখে একরাশ হাসি নিয়ে এসেছিলাম। ইনকামের টাকা বউকে দেখিয়ে হাসাবো ভেবেছি। নিমিষেই যেনো সব উড়ে গেলো। স্ত্রী এর কাছে আসতেই,সে আমাকে গতবারের মতো জড়িয়ে ধরে। আমি নিজের গা ওর দিকে হেলে দিয়েছি শুধু। ফারহানার পায়ের কাছে অনেক রক্ত জমে আছে। বউ আমাকে কান্নার স্বরে বলে," আজকেও আপনি বের হবার পর আবার ফিরে এসেছেন। আমি জিজ্ঞেস করেছি কিছু লাগবে কিনা। তখন আপনি পূর্বের মতোই জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমার কোনো কথার উত্তরই দেন নি। সন্দেহ হয় আমার। গতবারের মতোই কিছু হয় কি না। সেই ভয়। আমি সূরা পাঠ করতেই যাবো,তখনি আপনি দৌড়ে এসে আমার পেটে লাথি মেরেছেন। আমার সারা শরীর কেঁপে উঠেছে। অনেক রক্ত যেতে শুরু করে। ভয়ে চিৎকার দিয়ে আমি উঠোনে বের হয়ে আসি। এরপর দেখি উঠোনে আপনি নিজের গলা নিজে কেটে যাচ্ছেন। ভয়ে জোরে জোরে চিৎকার করতেই থাকি। এদিকে আমার গর্ভপাত হয়ে যায়। এই বাচ্চাও নষ্ট হয়ে গেছে গো।" বলেই ফারহানা গুমরিয়ে কান্না শুরু করে। আমি একটা কথাও বলিনি। বলার ভাষাও নেই।
সম্মানিত পাঠক স্রোতা। এইভাবেই শুরু হয় মোস্তফা কাকার জীবন কাহিনি। একটি কালো অধ্যায়ের পথচলা কি তিনি শেষ করতে পেরেছিলেন? বাচ্চা কিন্তু আরো জন্ম হয়েছিলো। কিন্তু কি হয়েছিলো তখন? আর এই বাচ্চা খেকো কে? যে বার বার মোস্তফা কাকার বাচ্চা নিয়ে যায়। এখানে কি আসলেই আলগা-বাতাস একটা? নাকি আরো অনেক রয়েছে। তাছাড়া উনারা কি শেষ অব্দি মুক্তি পেয়েছিলেন। জানবেন, " বাচ্চা খেকো " গল্পের পুরো ই-বুকে। ই-বুকটি পাবেন বইটই এপে। বিস্তারিত কমেন্টে দেওয়া আছে।
গল্প- বাচ্চা_খেকো।
লেখক- রিয়াজ রাজ