স্বামীর সংসার
মায়ের ইউ এস এ যাবার ফ্লাইট রাত একটায়। সেই হিসাবে বাসা থেকে কমপক্ষে দশটায় বেরুনো উচিত। এখন বাজে দুপুর দুইটা, অথচ মা এখনো বাসায় ফেরেনি। লাগেজ ও গোছানো হয়নি। মায়ের ফোনও বন্ধ,তাই যোগাযোগ করতে পারছিনা।
সবাই আমাকে প্রশ্ন করছে কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারছিনা। এমন নয় যে আমি জানিনা মা কোথায় গেছে কিন্তু যে টুকু জানি তা কোন তথ্য নয়। আর কি করে বলবো, আমার পঞ্চাশউর্ধ্ব মা যেখানে যাবে বলে যায় আসলে সেখানে যায় না। উনি যান একজন পুরুষের কাছে, যে কিনা তার থেকে কমপক্ষে দশ বছরের ছোট। হ্যাঁ, তিনি এখন মায়ের বর্তমান স্বামী। ভাবছেন আমার মা আমাকে বলেছে, না না ,তিনি আমার কাছেও লুকিয়েই রেখেছেন।
গতবার মা আসার পর থেকে মায়ের চলা ফেরা, আচরণ, সাজগোজ আর ফোনে কথা বলা সব কিছু আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগতে শুরু করে। আমার মনে না না রকম সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। তাই আমি স্পাই হয়ে যাই।
আমার মা অতটাও বুদ্ধিমতী নয়, বলা যায় মা অনেক টাই বোকা,তাই তার তথ্য বের করতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হয় নি।
প্রথমে কৌশলে মায়ের ফোনের আর ফেসবুকের পাসওয়ার্ড জেনেছি, আর তারপর মায়ের ফেসবুক, মেসেন্জার,কল লিস্ট ঘেটে মেসেজ চেক করে ঐ লোকের ফেসবুক আইডিতে ঢুকে জেনে নিয়েছি ঐ লোকের নাম, বয়স আর মায়ের সাথে তার সম্পর্ক। ঐ লোকের আইডি তে মায়ের সাথে তার বিয়ের একটা ছবিও দেয়া আছে।
এসব দেখে খুব কষ্ট পেয়েছি, গোপনে অনেক কেঁদেছি কিন্তু মাকে কিছুই বলিনি, কোন প্রশ্ন করিনি। লজ্জা, সংকোচ, দ্বিধা আমাকে আটকে রেখেছে। যার পঁচিশ বছর বয়সের একটি মেয়ে আছে সে এরকম একটা কাজ করতে পারে তা আমার কল্পনাতেও আনতে পারি না, অথচ তাই হয়েছে।
অবশ্য এতে আমি মায়ের দোষ ও দিতে পারিনা। যে মানুষ আজন্ম ভালোবাসার কাঙাল সে ভালোবাসার প্রলোভনে পিছলে তো যাবেই। যেভাবে পিছলেছিলেন ছাব্বিশ বছর আগে আমার বাবার পেতে রাখা ফাঁদে পা দিয়ে।
নানির মুখে শুনেছি, মা বাসার সবার অমতে বাবাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সেই ভালোবাসা কর্পূরের মতো উরে গেল বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই।
আমার বাবা ছিলেন একজন অমানুষ। আমার বোকা মা তা বুঝতে পারেননি। মুখোশের আড়ালে লুকানো আমার বাবার আসল রূপটি উনি দেখতে পাননি। যখন দেখেছেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে আমার অস্তিত্ব চলে এসেছে তার শরীরে। অতঃপর মা সব কিছু সয়ে গেলেন। ভাবলেন সন্তানের মুখ দেখলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে দেখেছি বাবা নেশা করে বাড়ি ফিরে, মাকে ঠিক মতো সংসার খরচ দেয় না আর প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া হয়। তখন ঝগড়ার বিষয় বস্তু বুঝতে না পারলেও আর একটু বড় হয়েই বুঝতে পেরেছি, আর তা হলো পরনারী আসক্তি।
তবে মাঝে মাঝে কিছুদিন বাবা ভালো হয়ে যেতেন, তখন আমরা খুব ভালো থাকতাম, দাদি বাড়ি বেড়াতে যেতাম। এভাবেই বাবার সাথে মায়ের ও আমার জীবন কাটতে লাগল।
আমার বড় চাচা আমেরিকায় থাকেন। তিনি বাবার জন্য আমেরিকার ফ্যামিলি মাইগ্রেশন ভিসার এপ্লাই করেছিলেন। আমার যখন বাইশ বছর বয়স তখন বাবা মায়ের আমেরিকার ভিসা হয়ে যায়। আমার বয়সের সময় সীমা পেরিয়ে যাওয়ায় আমি যেতে পারি না। রয়ে যাই নানির কাছে। মা তখন আমায় রেখে যেতে চাইছিলেন না। আমিই মাকে জোর করে পাঠাই, কারন জীবনে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা একটি বিরাট বিষয়। আমার নানির পরিবার অতটা সচ্ছল নয়। মধ্যবিত্ত পরিবার। নানা গত হয়েছেন বহু বছর আগে। নানার সম্পদ বলতে শুধু মাত্র ঢাকায় একটি টিনসেড বাড়ি। মামার চাকরির টাকায় সংসার চলে। মামার আবার দুই ছেলে মেয়ে, তাদের স্কুলের খরচ, সংসার খরচ সব মিলিয়ে টানাটানি অবস্থা।
মা বিদেশে গিয়ে কাজ শুরু করলেন। টাকা পাঠাতে লাগলেন, সংসারে সচ্ছলতা আসলো। আমার রাশভারি মামীও এখন ডলার পেয়ে খুশি।আমার সাথে আগের চেয়ে হাসি খুশি থাকেন। যেখানে আগে খুব একটা কথাই বলতেন না, এখন ভালোই গল্প করেন। আর আমার মা ও ধীরে ধীরে স্মার্ট হতে লাগলেন।
বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়লেন আমার বাবা। সেখানে অনায়াসে অন্য নারীর সাথে মৌজ মাস্তি করা যায় তবে বউ প্রতিবাদ করলে বউ পেটানো যায় না। কিন্তু বউ পেটাতে না পারলে তার তো আবার হাত নিশপিশ করে, বহু বছরের অভ্যাস যে। তো একদিন তিনি সেই কাজ করেই ফেললেন। ব্যস্, হয়ে গেল কাজ। প্রতিবেশী পুলিশ কল করে দিলেন। পুলিশ এলেন।পুলিশ মাকে জিজ্ঞেস করলেন-
-তুমি কি করতে চাও?
জানিনা আমার ভিতুর ডিম মা এতটা সাহস কোথায় পেলেন, তিনি দৃঢ় কন্ঠে বললেন-ডিভোর্স।
যেদিন মা ডিভোর্স এর কথা জানালেন সেদিন আমি আর নানি দুজনেই খুশি হয়েছিলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম যাক্ অনেক দেরি হলেও মা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।
আর আমার নানি তার ফোকলা দাঁত বেরকরে বললেন-হেরে কত কইছি মাইয়াডা লইয়া আইয়া পর, আমরা ডাইল ভাত খাইয়া বাচমু। কতা হুনে নাই। কইত আল্লায় হেরে ভালা কইরা দিব। আরে, কুত্তার লেজ কি কুন সময় সোজা অয়?বার বছর তারে চুঙ্গায় ভইরা রাখলেও বেকাঁই থাহে।
বার বছর না,ছাব্বিশ বছরেও আমার বাবা শোধরালেন না।তবু মানুষের হৃদয় বড়ই অদ্ভূত, বড়ই বিচিত্র। হৃদয়ের কোন এক কোনে বাবার জন্য এক ক্ষুদ্র ফোঁটা ভালোবাসাও হয়তো ছিল,তাই বাবার জন্য ও মনটা খানিকটা পুড়ল। আসলে বাবা তো।আমায় কিছুটা ভালোও বাসতেন।
তবে ডিভোর্সের পর বাবা ভালোই আছেন। শুনেছি কোন এক মহিলার সাথে লিভ টুগেদার করছেন।
আর মা?
আমরা ভাবতাম মা ও ভালো আছে। ঠিক মতো টাকা পাঠাচ্ছে। নানির পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে, আমি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে পড়ছি। বাহ্, এটাই তো সুখ। কিন্তু মা কি আদৌ ভালো ছিলেন? যদি থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই বিকল্প চিন্তা করতেন না।
গতবার মা এসে বললেন তিনি যে কটা দিন বাংলাদেশে থাকবেন সে কটা দিন তার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী মিতার সাথে রাতে থাকবেন। সবাই তা সানন্দে মেনে নিল। কারন মিতা আন্টি আর মা দুজনে জানের জান বন্ধু। আর মাত্র এক বছরই হলো মিতা আন্টির স্বামী ব্রেইন স্ট্রোক করে পরপারে চলে গেছেন।তাই দুজন এক সাথে থাকলে দুজনেরই ভালো সময় কাটবে।
এবার এসেও মা একই কথা বললেন, কেউ আপত্তি করল না। সবাই ভাবল পনেরো দিনই তো ,থাকুক।শুধু আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল।
যখন থেকে মা আবার বিয়ে করে মিথ্যে কথা বলে রাতে বাইরে থাকা শুরু করলেন তখন থেকে এক ধরনের ভয় আর আতঙ্ক আমার মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে শুরু করল। একটা প্রশ্ন সব সময় আমাকে তাড়া করে- মা বাংলাদেশে থাকা এই লোকটার সাথে জুড়লেন কিভাবে? কে তাকে জড়াল? আর লোকটাই বা কোন স্বার্থে এই বয়সি একজন মহিলাকে বিয়ে করল? ভালোবাসা?তাও কি সম্ভব? আমার তো মনে হয় না। আমার কেন মনে হয় এর পিছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে বা স্বার্থ অবশ্যই আছে। তবে স্বার্থ টা কি? মায়ের মাধ্যমে আমেরিকা যাওয়া, নাকি অন্য কিছু?
মা যখন বাইরে যায়, তখন মাকে বলতেও পারি না যেখানে যাচ্ছ তার ঠিকানা দিয়ে যাও, কারন তিনি ভিন্ন পরিবেশে সৃষ্টি করে রেখেছেন।আবার এ কথা কারও সাথে শেয়ার ও করতে পারিনা,শুধু নীরবে গুমরে কাঁদি। গতবার মা চলে যাবার পর আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু না, বছর না ঘুরতেই তিনি আবার এলেন। আবারও সেই একই আতঙ্ক, একই ভয়।
সময় যতটা পেরিয়ে যাচ্ছে, আমার আতঙ্ক ততটাই তীব্র হচ্ছে। সকাল থেকে জানিনা কেন মনটা খুব কু ডাকছে। বার বার মনে হচ্ছে মায়ের সাথে কিছু কি হয়েছে? মায়ের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ছটফট করছি। কিন্তু কিভাবে। হটাৎ মনে পড়ল ঐ লোকের ফোন নম্বর লুকিয়ে লিখে রেখেছিলাম একটা ডায়রিতে। আমি দৌড়ে পড়ার টেবিলে এলাম। ডায়েরি থেকে নাম্বার বের করে দুরু দুরু বুকে কল করলাম। ফোন বন্ধ। এখন?
এমন সময় মামা এলেন আমার রুমে। তার চেহারায় আতঙ্ক স্পষ্ট। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন-
-অথৈ, তোর মা তো মিতার বাসায় যায় নি। আমি মিতা কে ফোন করেছিলাম।
আমি খুব আস্তে করে বললাম-
-জানি।
মামা অবাক হয়ে বললেন-
-জানি মানে, তুই জানিস তোর মা কোথায় গেছে।
-হুম।
-কোথায়?
-হাসিব নামের একজন লোকের কাছে।
এবার মামা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন।
-কি বলছিস এসব? হাসিব নামের লোকের কাছে কেন যাবে?
-কারন তিনি এখন মায়ের স্বামী।
এবার মনে হয় মামার বিস্ময়ের সীমা অতিক্রম করল। আমার কাছে এসে আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল-
-তুই এসব কি বলছিস? কবে, কখন এসব হলো?
আমি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম-
-গতবার মা যখন এলেন, তখন। আমি গোপনে সব জেনেছি। লজ্জায় তোমাদের বলতে পারিনি।
মামা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম।
নানি মিন মিন করে বলে উঠলো-
-হায় হায়, আমার মাইয়া এইডা কি করল? কেমনে করল?
কিছুক্ষণ পর মামা বললেন-
-তোর কাছে ঐ লোকের ঠিকানা আছে?
-না, আমার কাছে শুধু তার ফোন নম্বর আছে। ফোন করে দেখেছি। তার ফোন ও বন্ধ।
-তোর মায়ের পাসপোর্ট কই?
-আমার কাছে। কিন্তু মায়ের কাছে বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইডি কার্ড আর আমেরিকার গ্রীন কার্ড আছে। মামা চল আমরা থানায় যাই।
-থানায়? মামার চেহারা কেমন যেন করুণ হয়ে উঠল।
মামী দৌড়ে এসে বলল না না,থানায় যাওয়া যাবে না। মান ইজ্জতের ব্যাপার আছে। এলাকায় এই কথা জানাজানি হইলে আমরা মুখ দেখাইতে পারব?
আমি চিৎকার করে বললাম-
মামা মান ইজ্জতের চেয়ে আমার মায়ের জীবন বড়। মাকে বাঁচাতে হবে মামা। জানিনা কোন বিপদে পড়ে আছে।
মামা চুপ করে বসে রইলেন, আমার কান্না আবার বেড়ে গেল। আর মান ইজ্জতের গ্যারাকলে আটকে সময় পেরিয়ে যেতে লাগল।
সন্ধ্যা পার হয়ে গেল মা ফিরে এলো না। হটাৎ মামা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-
-অথৈ চল। চল পুলিশের কাছে যাই।
মামী কিছু বলতে যাবে তার আগেই মামা হাত দেখিয়ে মামী কে থামালেন। তারপর আমার মাথায় নির্ভরতার হাত রেখে বললেন-
-চল,ভয় করিস না, তোর মাকে আমরা খুঁজে বের করব, কিচ্ছু হবে না তার। চল।
আমি মামার হাত ধরে দরজার দিকে এগোতে লাগলাম আর ঠিক তখনই খুব কাছেই কোথাও পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পেলাম।
সমাপ্ত।
অজানা
লেখক:🔳®Md. Rezaul Hok..!