বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প
গল্প: “কালো রঙের মানুষটা”
আমার নাম লিটন খান। গায়ের রঙটা কালো বলে ছোটবেলা থেকেই মানুষ আমাকে আলাদা চোখে দেখত। কেউ বন্ধুত্ব করতে চাইত না, কেউ পাশে বসতে চাইত না। এমনকি আত্মীয়স্বজনও আড়ালে হাসাহাসি করত—“ওর বরাতেই সমস্যা আছে, মানুষ হইছে কয়লার মতো।”
কিন্তু আমি সব সহ্য করতাম। মুখে হাসি রাখতাম, ভেতরে হাজারটা কষ্ট লুকিয়ে রাখতাম। ছোটবেলায় যখন অন্য ছেলেরা আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেকে ভালোবাসত, আমি তখন আয়নায় নিজেকে দেখে শুধুই প্রশ্ন করতাম—“আসলে আমি দোষ করলামটা কী?”
তারপর কলেজজীবনে এলো ঝর্ণা। খুব হাসিখুশি, চঞ্চল আর মিষ্টি স্বভাবের একটা মেয়ে। প্রথমে আমি ওকে পাত্তা দিইনি, কিন্তু ও নিজেই কাছে এসে বন্ধুত্ব করেছিল। বলেছিল, “তোমার মনটা এত ভালো, তোমার মতো ছেলে নেই!” ধীরে ধীরে ওর আচরণে বিশ্বাস জন্মে গেল। একদিন সরাসরি বলেও ফেলেছিল, “তোমাকে আমি পছন্দ করি, রঙ দিয়ে কী হয়?”
আমি বিশ্বাস করেছিলাম, ভেবেছিলাম—এবার হয়তো ভালোবাসা সত্যি হবে।
কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, ওর সবটাই ছিল মজা। ওর বান্ধবীদের সামনে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করত, বলত, “এই দেখো, কালো ছেলে প্রেমে পাগল হয়ে গেছে।” কখনও বলত, “জীবনে কালো একটা ছেলেকে না নিয়ে প্রেম করলে প্রেমটাই অসম্পূর্ণ থাকে।”
একটা সময় ছিল, যখন রাতে একা বসে কাঁদতাম। ঘুম আসত না, বুকের ভিতরটা হাহাকার করত। তবু মুখে কিছু বলতাম না, কারণ আমি জানতাম, একদিন ঠিক প্রমাণ করতে পারব আমি কে।
এরপর শুরু হলো সংগ্রামের জীবন। নিজের পকেটে টাকা নেই, অভিজ্ঞতা নেই, কেউ পাশে নেই—তবুও লোন নিয়ে ব্যবসা শুরু করলাম। প্রথমবার ব্যর্থ, দ্বিতীয়বারও ধাক্কা খেয়েছি। অনেকে বলেছিল, “তোর দ্বারা হবে না।” কিন্তু আমি জানতাম, আমাকে হতে হবে, প্রমাণ করতেই হবে।
অনেক রাত না খেয়ে কাটিয়েছি, প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছি। ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার নিজের কোম্পানি হলো, তারপর আরও কয়েকটা ব্যবসা। একসময় সেই কলেজের বন্ধুরা, যারা আমায় নিয়ে হাসত, আজ তারা আমার অফিসে চাকরি চাইতে এসেছে। আমি কাউকে ফিরিয়ে দিইনি। সবাইকে দিয়েছি।
তারপর একদিন হঠাৎ ঝর্ণার সঙ্গে দেখা। বদলে যাওয়া এক ঝর্ণা—চোখে পানি, চেহারায় ক্লান্তি। সে জানাল, তার জীবন আর আগের মতো নেই। ভুল বন্ধুত্ব, মিথ্যে ভালোবাসা, একের পর এক প্রতারণা—সবকিছুর মাঝে সে বুঝে গেছে, আমি ছিলাম সবচেয়ে সত্যিকারের মানুষটা।
ঝর্ণা বারবার চেষ্টা করল আমার সঙ্গে দেখা করার। আমার বাড়িতে এসে দাঁড়িয়ে থাকত, কেঁদে ফেলত ফোনে। এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল কয়েকবার। একদিন আমার মা বললেন, “ভুল করে ফেলেছে মেয়ে, ক্ষমা করে দে বাবা।”
মনটা নরম হয়ে গেল। আমি জানি, ভালোবাসা মানে শুধু আগলিয়ে রাখা নয়, ভালোবাসা মানে কাউকে বদলে ফেলার সুযোগ দেওয়া।
আমি রাজি হলাম।
ঝর্ণাকে বিয়ে করলাম, এবং আল্লাহর রহমতে এখন আমরা খুব ভালো আছি। আমাদের সংসারে এখন তিনজন সন্তান—দুই ছেলে, এক মেয়ে। আমি সব সময় বলি, “আরও সন্তান চাই, আরও ভালোবাসা চাই, আরও আনন্দ চাই।”
ঝর্ণা এখন সত্যিকারের একজন সঙ্গী—আমার পাশে ছায়ার মতো থাকে, নিজের ভুলের জন্য এখনও মাঝে মাঝে চোখে পানি চলে আসে তার।
আজ যখন আয়নায় তাকাই, আর নিজেকে দেখি—কয়লার মতো নয়, একটা দীপ্তি দেখি। কারণ আজ আমি জানি—
এই সমাজ রঙ দেখে, গায়ের চামড়া দেখে, কিন্তু একসময় তারা মাথা নিচু করেই বলে—লিটন খান, তুমি সত্যিই একজন মানুষ।
আর মানুষ যদি নিজের বিশ্বাসে অটল থাকে, তাহলে সেও একদিন ইতিহাস হয়ে ওঠে।