অবহেলার কষ্টের গল্প
আমার একমাত্র বড় ভাইয়ের স্ত্রী মিতু ভাবীর ব্যবহার ইদানিং অদ্ভুত রকম লাগছে। ভাইয়া ঢাকাতে চাকরি করে। গ্রামের বাড়িতে আমি, মা-বাবা আর ভাবী থাকি। মা-বাবা এক রুমে, আমি পূর্ব দিকের রুমে আর ভাবি থাকেন পশ্চিম দিকের রুমটায়।
আমি খেলাধুলার চরম ভক্ত। টিভিটা যেহেতু ভাবীর রুমে তাই স্বাভাবিকভাবে আমাকে খেলা দেখতে গেলে ভাবীর রুমে যেতে হয়। ভাইয়া থাকলে রাতেও খেলা দেখি কিন্তু ভাইয়া ঢাকায় থাকায় এখন রাতের খেলা আর দেখা হয় না শুধুমাত্র দিনের খেলা গুলোই দেখি।
কয়েকদিন আগে নিউজিল্যান্ডের একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হচ্ছিল। আর তাই আমি ভাবীর রুমে গিয়েছি খেলা দেখতে। আমি ওখানে গিয়ে খেলা দেখতেছিলাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম ভাবী কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছেন। কিন্তু আমি তো এই ম্যাচটা দেখেই চলে যাবো উনার সারাদিনের সিরিয়াল দেখাতে কোনোরকম বিঘ্নতা ঘটাবোনা তার পরেও তিনি কেমন যেন করছিলেন। সাউন্ড ছিল ১২তে। হঠাৎ ভাবী বলে উঠল "এই আকাশ শোনো, ভলিউম এত বাড়িয়ে টিভি দেখো কেন? বলি কী ভলিউম বেশি বাড়াতে হয় না। তাহলে স্পিকারের সমস্যা হয় খুব তাড়াতাড়ি। স্পিকার নষ্ট হয়ে যায়। এটা তো বোঝা উচিত ভাইয়া।"
আমি বললাম, " কিন্তু আমি তো এত ভলিউম দেইনি ভাবী।"
"তাহলে কি আমি ভুল শুনছি? যা দিয়েছো তাও আর দিবানা বুঝেছো তো?
"জ্বী আচ্ছা আমি বুঝেছি। "
এর আরও কিছুক্ষণ পর তিনি আবার বললেন "আচ্ছা আকাশ তুমি এত নড়াচড়া করে টিভি দেখো কেন? সোফায় বসে এভাবে নড়াচড়া করলে সোফার কভার নষ্ট হয়ে যাবে না? আর সোফায় বসে এভাবে নড়াচড়া করতে হয় না। কিছু মনে করো না, তোমার যদি অসুবিধা হয় তুমি বাবার রুম থেকে প্লাস্টিকের চেয়ারটা নিয়ে এসে আরাম করে দেখো কেমন?"
না এই কথাটা শুনে আমার খুব কষ্ট লাগলো। আমি সোজা উঠে চলে এসে বাবার রুম থেকে চেয়ারটা নিয়ে কিছুক্ষণ জোর করে টিভি দেখে সরাসরি চলে এসেছি। ভাল্লাগছে না কিছু। কয়েকমাস আগেই তো ভাবী অন্যরকম ছিল। এতো তাড়াতাড়ি এতো ভিন্নরকম হয়ে উঠলো কেন বুঝিনা।
ভাইয়া আমার জন্য প্রতিমাসে আলাদা করে ৫০০ টাকা ভাবীর কাছে পাঠায়। সে টাকাটা ভাবীর কাছ থেকে নিতে হয় আমাকে গিয়ে।
সেদিন ভাবীর রুমের পাশে গিয়ে ডাকলাম "ভাবী আছেন? "
" হ্যাঁ আসো। "
" ভাইয়া কি টাকা পাঠিয়েছেন আমার জন্য? "
" হ্যাঁ পাঠিয়েছে। দাঁড়াও আমি দিচ্ছি।"
তিনি টাকাটা নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন আর বললেন " আসলে তোমার ভাইয়া চাচ্ছিল একটা জায়গা কিনতে। আর তুমি তো জানোই ঢাকা শহরে একটা জায়গা কিনলে কত টাকার প্রয়োজন হয়। কোথা হতে যে এত টাকা জোগাড় করবে সেটা ভেবে ভেবেই তোমার ভাইয়া ক্লান্ত। আসলে সবাইকে দিয়ে ওর হাতে টাকা আর থাকে না। সবারই তো উচিত নিজের একটা টাকা আয়ের ব্যবস্থা করা তাই না? বলো? পরের কাছে হাত পেতে টাকা নেয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন ঘেন্না লাগে। ঠিক বলিনি বল? আর হ্যাঁ একটা কথা আমি কিন্তু তোমাকে মীন করে কিছু বলিনি। যারা এমনিতে তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নেয় তাদেরকে বুঝিয়েছি। তুমি কিছু মনে করো না আবার।"
ইচ্ছে হচ্ছিল টাকাটা রেখেই চলে আসতে কিন্তু পারিনি। পরের কাছে হাত পেতে টাকা নেয়া বলতে কী বুঝিয়েছেন ভাবী? ভাই আমার পর? কথাটা একদম অপ্রাসঙ্গিক। আমার আপন ভাই কিনা আমার পর? কথাগুলো যে তিনি আমাকে বলেছেন সেটা বোঝার আর বাকি রইল না।
না আর কোনদিন ভাইয়ের কাছ থেকে আমার জন্য এক্সট্রা টাকা চাইবো না। প্রয়োজন হলে টিউশনি করাব হাতখরচের জন্য। মাথাটা ভন ভন করছে।
আমি আমাদের এলাকার একটা কলেজে পড়ি। আমাদের কলেজ টা আমাদের বাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরের পথ। সাধারনত রিক্সা করেই কলেজে যেতাম কিন্তু এখন থেকে ভাবছি হেঁটে যাবো তার পরেও যদি কিছু টাকা সেভ হয়।
রবিবার দিন দুপুরে বটতলার পাশের বড় মাঠে বিরাট একটা ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। পুবপাড়ার সাথে আমাদের পাড়ার খেলা। দর্শক জড়ো হয়েছে মাঠের চারপাশে। জুনিয়রদের মধ্যে একমাত্র আমাকে নেয়া হয়েছে খেলাতে। অনেক উত্তেজনা কাজ করছে। এই খেলার হার জিত নিয়ে অনেক কথা হয়। দেখা যাবে হারলে কলেজে পচানো হচ্ছে একে অপরকে। অনেক আগে থেকেই এই প্রতিদ্বন্দ্বীতাটা হয়ে আসছে। মেয়েরাও খেলা দেখতে এসেছে। মহিলারা, মুরব্বিরা একটা সাইডে চেয়ারে বসেছেন। চারপাশে হই হই ব্যাপার। যথারীতি খেলা শুরু হয়েছে।
প্রায় দু'টার দিকে খেলা শেষ হলো। প্রচন্ড রোদের মধ্যে এত মনোযোগ দিয়ে খেলেও আমরা হারালাম পুবপাড়ার ছেলেদের সাথে। তারা ট্রফি নিয়ে আনন্দ করতে করতে তাদের এলাকায় চলে গেল। আর আমরা মন খারাপ করে যে যার মত বাড়ি ফিরলাম। এ নিয়ে টানা দুইবার হারালাম পুবপাড়ার ছেলেদের সাথে। বাসায় আসলাম বেশ খানিকটা হতাশা নিয়ে। প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে দৌড়ে গেলাম ভাবীর রুমের দিকে। নক করে ভেতরে ঢুকে ফ্রিজ থেকে পানির বোতলটা নিলাম।
ভাবী হয়তো বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছিলেন। তিনি উঠে বসে আমায় কড়া ভাবে বললেন "আকাশ এভাবে কেউ ফ্রিজ খুলে? এভাবে কয়েকবার টান দিয়ে ফ্রিজ খুললে তো দুদিনেই নষ্ট হয়ে যাবে এটা। আর একটু পর পর এত ফ্রিজ খোলাখুলি কিসের জন্য সে আমি বুঝিনা। এটা অনেক দামি ফ্রিজ সেটা তুমি জানো। এটা নষ্ট হয়ে গেলে এখানে আশেপাশে ঠিক করানো যাবে না। একটু কেয়ারফুল হতে হয়। এই ব্যাপারগুলোতে বড় হচ্ছো আজও বুঝোনা কেন? "
আমি যেন কাঠ হয়ে গেলাম। খেলা হারার কষ্টটা তুচ্ছ অনুভূত হলো। বুকের ভেতর দিয়ে কথার আঘাত কতটুকু ছেদ করতে পারে এই প্রথম এত ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হল।
ছাদে গিয়ে কেন জানি নিজেকে খুব তুচ্ছ ও ছোট মানুষ মনে হল। ভেজা চোখ মুছে ঠিক করলাম এখন থেকে ভাবীর ফ্রিজের আশেপাশেও আর যাব না।
এভাবেই দিন যায়। আমি ভাবীর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছি যতটুকু সম্ভব। মাঝে একবার ভাইয়া এসেছিলো। ভাইয়া আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল " কিরে তুই টাকা নিস না কেন এখন?"
আমি বললাম "আমি টিউশন নিয়েছি। হাত খরচ আর দিওনা। অভ্যাস করছি টাকা উপার্জনের। আর যদি লাগে তোমাকে আমি বলব।"
ভাইয়া তৃপ্ত হলো আর কিছু বলল না। শুধু এটুকুই বলল "আচ্ছা লাগলে আমায় বলিস। "
পরের বছরের শুরুটা বেশ আনন্দময় ছিল আমার জন্য। ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলেছে। আমি কাকা হতে চলেছি। আর ভাইয়া বাবা হতে চলেছে।
আজ তিন দিন হল গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। যদিও সন্ধ্যা থেকে আকাশের বিদ্যুৎ অবিরতভাবে চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির জন্য এশারের আজান টাও ঠিকমতো শোনা গেল না। বাবা আর আমি বারান্দায় বসে আছি। বৃষ্টির সময় বারান্দাতে বসে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। অবশ্য মানুষের অনেক গুলা ভালোলাগা থাকে কারণ ছাড়া ঠিক সেগুলার একটা হচ্ছে আমার বৃষ্টির সময় বারান্দায় বসে থাকাটা। কেন ভালো লাগে সেটা আমি জানি না। কিছুক্ষণ পর আমি আমার রুমে গেলাম। রুমের জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকালাম। যদিও কিছু দেখা যাচ্ছে না তবুও কাল্পনিক আর বাস্তবতার সংমিশ্রণে একটা খুব সুন্দর ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের উঠোনে অনেক গোলাপ ফুলের গাছ আছে সেখানে ফুল ফুটেছে। অনেক পাহারা দিয়ে রাখতে হয় এলাকার ছেলেপুলেদের জন্য। না বলে সুন্দর ভাবে তারা ছিঁড়ে নিয়ে যায়। ফুলগুলোর ওপর বৃষ্টির পানি পড়ছে আর ফুলগুলোর গন্ধ যেন চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সুন্দর, অমায়িক, লাবণ্যময়ী সুঘ্রাণ।
আমাদের বাসার ঠিক পেছনেই আম বাগান এবং আম বাগানের পাশে ঘন লতাপাতার ঝোপ-ঝাড়। ঝোপঝাড়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে কেমন একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। আমার কাছে তাই মনে হয়। বেশ ভালো লাগে এটা আমার কাছে। কিছুক্ষণ পর বাতাস বইতে শুরু করেছে। আমার মা অন্য রুমে শব্দ করে সূরা ফাতিহা পড়ছেন। ঠিক তখন হঠাৎ ভাবীর চিৎকার শোনা গেল। আমরা সবাই ছোটাছুটি করে ভাবীর রুমের দিকে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখলাম ভাবী বিছানায় শুয়ে প্রচন্ড কান্না করছেন আর ব্যাথা ব্যাথা বলে চিল্লাচিল্লি করছেন। মা তাড়াতাড়ি গিয়ে ভাবীকে ধরলেন। আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভাবীর চিৎকার দেখে আমার কান্না চলে আসছে। আমার আপন কোন বোন নাই তো তাই ভাবীকে আপন বোন ছাড়া কখনো অন্য কিছু ভাবিনাই। আর এই কারনেই বোনের কষ্ট দেখে আমার অটোমেটিক কান্না চলে এসেছে। বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন " কান্নাকাটি করিস না কিছু একটা করতে হবে। "
বাবা আমার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। রিকশা বা ভ্যান ওয়ালা কাউকেই পাবোনা।
সজল মিয়া আমাদের এলাকার ড্রাইভার তার একটা রিকশা আছে। ফোন দিলাম তার নাম্বারে। ফোন বন্ধ। কী করবো বুঝতেছিনা কিছুই। ওদিকে ভাবীর কান্না শুনে শুনে মাথাটা ঘুরতে শুরু করেছে। লাইটটা আর ছাতাটা নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে গেলাম। বাবা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। থম থমে কালো রাত। চারপাশে অন্ধকার। ভূতের ভয় আমার মধ্যে প্রচন্ড রকম ভাবে আছে কিন্তু এ মূহুর্তে এসব ভাববার সময় নাই। সজল মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখি আরেক কান্ড। কী করবো কিছুই বুঝলাম না। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়লাম।
ধূসররঙ
পর্ব - ০১)
গল্পঃধূসররঙ
(পর্ব - ০২ তথা শেষ পর্ব)
ভাবীকে হাসপাতালে কীভাবে নেব কিছুই বুঝতেছিনা। সজল মিয়া জ্বরাক্রান্ত হয়ে তার ঘরে শুয়ে আছে। প্রায় পাঁচ দিন ধরে তার জ্বর। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তারের কথামতো সে এখন রেস্টে আছে। রিকশা কেউ চালায় না। তাহলে উপায়? ভাবীকে তো হাসপাতালে নিতেই হবে। এই মুহূর্তে আমি কি করব ভেবে না পেয়ে মাটিতে বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পর ভাবলাম না এভাবে বসে থাকলে চলবে না ভাবীর অবস্থা হয়তো আরো খারাপ হয়ে যাবে। আমি সজল মিয়াকে বলে তার রিক্সাটা আনতে গেলাম উঠোনের মাঝে। লাইট আর ছাতাটা রিকশার মধ্যে রেখে আমি নিজে চালিয়ে চালিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরতে লাগলাম।
চারপাশে অন্ধকার কোথায় কি আছে ভালোভাবে দেখা যায়না। লাইটটা একহাতে অন করে রাস্তার দিকে ধরে আছি। আর জোরে জোরে রিকশা চালিয়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছি।
আমাদের এলাকার রাস্তা খুবই খারাপ। কত রকম চেয়ারম্যান কত রকম নেতা এল আর গেল সবাই শুধু মধুর মুখে বলল এই রাস্তাটা ঠিক করে দেবে কিন্তু কেউই দিনশেষে ঠিক করল না। আসলে এটাই মানুষের ধর্ম। বিশেষ করে নেতা মানুষের ধর্ম। কত সুন্দর ভাবে, অমায়িক ভাবে, মাসুম হয়ে তারা এসে ভোট চায়। এই করে দিবে সেই করিয়ে দিবে বলে অঙ্গীকার দেয়। কিন্তু দিন শেষে তারা কিছুই করে না। নিজের পকেট, নিজের পরিবার আর নিজের সম্পত্তি বৃদ্ধি করে আর আমরা জনগন কী অবস্থায় আছি সেটা একবার ভেবে দেখারও তাদের আর সময় হয়না।
আপনি যদি তখন একটা কাজে তাদের বাসায় যান দেখবেন নানারকম বাহানা ধরে দিয়েছে এবং আপনাকে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেবে সে অনেক ব্যস্ত অনেক ঝামেলার মধ্যে আছে। তবে কিছু কিছু মানুষ অবশ্যই ভালো আছে। ভালো ছাড়া কি আর দেশ চলে?
যাই হোক এই ভাবেই ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে আমি রিক্সা চালিয়ে চালিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলাম। রিকশাটা বেশ কয়েকদিন ধরে চালানো হয় না। ক্রেক ক্রেক শব্দ হচ্ছে। আর আমার চালাতে কষ্টও হচ্ছে বেশি।
আমার বাড়ির উঠোনে এনে থামালাম। ঘরে গিয়ে দেখলাম ভাবী তখনো কাতরাচ্ছে ব্যাথায়। আমি কি করবো বাবাকে বললাম। বাবা বলল," এখন তো একটাই উপায় হাসপাতালে নেওয়া। "
ভাবীকে আমি আর মা মিলে ধরে রিক্সায় উঠলাম। মা আর ভাবী পেছনের সিটে বসেছে আমি তাদেরকে একটা কাগজ দিয়ে ঢেকে দিলাম যাতে বৃষ্টির পানি না পড়ে।
মা বলল " বাবা তুই চালাতে পারবি তো? "
আমি বললাম "মা সমস্যা নাই আমি যতটুকু সম্ভব সাবধানতার সাথে চালাবো প্রয়োজন হলে হেঁটে হেঁটে টেনে টেনে নিয়ে যাব। "
ভাবী নেতিয়ে যাওয়া মুখে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতে যেয়েও যেন তিনি বলতে পারছেন না। তার মুখটা শুকিয়ে গেছে। আমার ভাবী অনেক সুন্দরী। সুন্দরী দেখেই আর পারিবারিক শিক্ষা দেখেই তাকে বিয়ে করিয়েছিলেন বাবা- মা। সেই সুন্দর মুখটার মধ্যে কেমন যেন একটা কষ্টের ছাপ এই কয়েক মুহুর্তেই হয়ে গেল।
ভাবী হাত দিয়ে কিছু একটা বুঝিয়েছেন কিন্তু আমি সেটা ঠিক বুঝিনি। ভাবী মায়ের কাঁধে হেলান দিয়ে বসে আছে।
আমি ওদেরকে কাগজ দিয়ে ঢেকে দিয়ে রিকশা চালাতে শুরু করলাম।
বাবাকে বললাম ঘর সামলে রাখতে। বাবা থাকুক বাড়িতে। যদিও বাবা খুব করে চাচ্ছিল যেতে কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি বাইরে এত প্রচণ্ড বৃষ্টি, অন্ধকার কিভাবে আরেকটা মানুষ যাবে?
আর ছাতাটা সাথে নিয়ে এসেছি। লাইটটাও সাথে নিয়ে এসেছি। বাবা ইচ্ছা করলেও যেতে পারবেনা।
রিক্সাটাকে ধীরে ধীরে চালাতে চালাতে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি। আমাদের এলাকার রাস্তাটা এতটাই খারাপ যে এখানে ভাঙ্গা তো আছেই পাশাপাশি একটু বৃষ্টি হলে এখানে পানি লেগে যায়। আর পানি থাকার কারণে আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল কোথায় গর্ত আর কোথায় গর্ত নেই। তাই রিক্সাটাকে না চালিয়ে আমি রিক্সা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে টেনে টেনে ধীরে ধীরে তাদেরকে নিয়ে যেতে লাগলাম। এখানে নর্দমার পানি থেকে বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে। আমার প্যান্ট ভিজে গেছে অনেকটা।
কিন্তু করার কিছু নেই। এই মুহূর্তে এসব ভাবলে চলবে না। ভাবী আরো জোরে কাতরাচ্ছে এতে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। আমি কি করবো?
কিন্তু এভাবে আমাকেও কাঁদলে তো চলবে না। আমি ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম।
মাঝেমধ্যে ভাবীকে বলতে শুনলাম, " আকাশ ভাই সাবধানে যেও। ভাই আমার সাবধানে যেও। তুমি নিজেকে সেফ রেখো কেমন। "
আমার কাছে এই কথাগুলো যেন মধুর মতো লাগলো। আমি ধীরে ধীরে পা দিয়ে গর্তগুলো অনুমান করে করে নর্দমার পানির উপর দিয়েই প্রায় আধা কিলো রাস্তা ঘন্টা খানিক সময় নিয়ে পেরুলাম।
এইভাবে রাস্তাটা পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠলাম। তখন আবার রিকশা চালাতে চালাতে ধীরে ধীরে লাইটটা ধরে ধরে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি।
পাছে এই ভয় হচ্ছিল হাসপাতলে আবার যদি কোন ডাক্তার না পাই তাহলে তো মহা বিপদ হয়ে যাবে।
আর আমাদের এখানকার হাসপাতালের অবস্থা জঘন্য। এখানে রোগীদের হতাশা হাহাকার থেকেই যায়। ঠিকমত চিকিৎসা দেয়া হয় না।
আমার খুব অবাক লাগে এই ভেবে যে, সব ছেলেমেয়েরা এককালে নিজেদের জীবনের লক্ষ্য বলার সময় বলতো আমি বড় হয়ে ডাক্তার হব, ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করব তাদের অনেকেই হয়তো তখন আর সেই মানুষের সেবার কথাটা মাথায় রাখেনা। অর্থের লোভে পড়ে মানুষ তার সেই লক্ষ্য ভুলে যায়। তখন শুধু দু চোখে টাকা দেখতে, দু হাতে টাকা নিতে জানে তারা। অবশ্যই সকল ডাক্তার না। ভালো তো কেউ কেউ আছেনই। তবে কিছু কিছু ডাক্তার আছে যারা সরকারিভাবে কিছুই ট্রিটমেন্ট করে না অথচ এরাই আবার প্রাইভেটভাবে গেলে কত সুন্দর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ট্রিটমেন্ট করে। করবেই না কেন তুমি ৫০০ টাকা ভিজিট দিয়ে দিয়েছো তো।
আরো প্রায় এক ঘন্টা পর আমি হাসপাতালে পৌছালাম। ভাগ্য ভালো ছিল সেদিন। কোন এক অফিসার না কে যেনো হাসপাতালে আসার কথা ছিল। যে কারণে বেশ ক'জন ডাক্তার ওই হাসপাতালে উপস্থিত ছিল।
আমি তাড়াতাড়ি ভাবীকে নিয়ে যাওয়ার পর একজন নার্সকে ডাকতেই উনি অবস্থা থেকে আমার কাছে তাড়াহুড়ো করে এলেন।
উনি ভাবীকে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে তারপর আমাকে বের হতে বললেন।
আমি বের হয়ে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর একজন ডাক্তার ঢুকলো রুমে।মোটামুটি সেদিন হাসপাতাল ফাঁকাই ছিল। একটু পর সে ডাক্তার এসে বলল যাতে দুশ্চিন্তা না করি, এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। দুশ্চিন্তা করার কিছু নাই।
কিন্তু তবু আমার কেন জানি খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। একবার ভেবেছি ভাইয়াকে ফোন দিব। কিন্তু ভাইয়াকে শুধু শুধু ফোন দিয়ে এখন জানানোর কোন দরকার নেই। কেননা ভাইয়া জানলে হয়তো রাতে রাতে এসে পড়ার চেষ্টা করবে। এত রাতে ঢাকা থেকে আসার কোন দরকার নেই। এর চেয়ে সকালে আসলেই হবে। আর আমি যেখানে আছি সেখানে ভাইজান পরে আসলেও প্রব্লেম নাই।
ভাবীকে ইনজেকশন অথবা কিছু দেয়া হয়েছে কিনা আমি শিওর না। তবে ভাবীর ব্যথা কিছুটা কমে এসেছে। একটু পর আমি ঢুকে বুঝতে পারলাম।
মা পাশে আর ভাবী একটা বেডে শুয়ে আছেন। আমার দিকে ভাবী চোখ টলমল করে তাকালেন। কিছু একটা বলতে চেয়েও যেন বলতে পারলেন না। খুব ক্লান্ত লাগছিল ভাবীকে। ডাক্তার বলল "হয়তো কয়েকদিন এখানে থাকতে লাগতে পারে।" এই অবস্থাতে পরিচর্যা করার জন্য হলেও তার একটা ভালো জায়গা দরকার। আর আমাদের বাসার অবস্থা শুনে তিনি এটাই বললেন এখানে থাকার জন্য।
এভাবে ধীরে ধীরে রাত এক'টা বেজে গিয়েছিল। আমি আম্মাকে বললাম পাশের বেডে শুয়ে পড়তে। আম্মা শুয়ে পড়লে আম্মার একপাশে আমিও শুয়ে পড়লাম। আর ভাবী অন্য একটা পাশাপাশি রাখা বেডে শুয়ে আছেন।
আমার আম্মার কিছু একটা হলেই মাথা ব্যাথা করে। বিশেষ করে আম্মা যখন দুশ্চিন্তা করে। একবার এমন হয়েছিল। আমার পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় যখন আমার টনক নড়লো না আমি যখন খেলাধুলা করে ঘোরাফেরা করে আনন্দ-ফুর্তিতে পরীক্ষার টেনশন ভুলে চলছিলাম চিল করে ঠিক তখন আমার আম্মা আমার পরীক্ষার কথা ভেবে ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে মাথা ঘুরে একবার পড়ে গিয়েছিলেন। দুশ্চিন্তা করলেই উনার মাথাব্যথা করে। আর মাত্রাতিরিক্ত হলেই অজ্ঞান হোন।
আম্মার মাথা ব্যথা করছিল তাই আমি আম্মাাকে বললাম "মা তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আর আমি তো আছি সমস্যা নাই। ভাবী যদি রাতে জেগে উঠে অথবা আবার যন্ত্রণাগ্রস্থ হয় আমি ডেকে নেব। তুমি শুয়ে পরো।"
ভাবী কিছুটা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। পাশে মা শুয়ে আছেন। আর আমি মায়ের পাশে শুয়ে পড়লাম। আমার ঘুম নেই। এখনি ঘুমালে চলবে না। দায়িত্ব আছে আমার অনেক।
চারপাশ নিরব। হাসপাতালের ঘড়িটা টক টক করে শব্দ করছিল। সাদা দেয়াল বেয়ে কয়েকটা টিকটিকি পোকা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। একে ওপরকে দৌড়ানি দিচ্ছে। এভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে রাত কখন শেষ হবে ভাবছি।
কিছুক্ষণ পর ভাবীর গোঙানির আওয়াজ পেলাম।
লাফ দিয়ে উঠে পাশে যেতেই উনি পানি খাবেন ইশারায় বুঝালেন। হায় আল্লাহ পানি কই পাবো। এসব টেপের পানি খাওয়ানো কি ঠিক হবে।
পাশে থাকা জগ খালি। তাড়াহুড়ো করে বাইরে গেলাম। একটা দোকান বন্ধ হতে চলেছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে একটা পানির বোতল কিনলাম। আবার দৌড়ে এসে ভাবীকে দিলাম। ভাবীর মাথাটা অল্প উঁচু করে খাওয়ালাম। আরো কিছুক্ষণ পাশে বসে থাকলাম। ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবীর চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি মনে হয় পড়লো।
হাতের ইশারা বুঝে আমি কাছে গেলাম। ভাবী আস্তে করে বললেন, "ভাই, ঘুমায়া পড়ো। যাও ভাই ঘুমাও।"
এরপর আরো কিছুক্ষণ পর আমি ঘুমালাম।
পরদিন ভাইয়া, আব্বা এসেছেন। আরো আত্মীয়রাও এসেছে।
এর আরো একদিন পর সেই কাঙ্ক্ষিত সময় এলো। সবাই অপেক্ষায় আছি। ছেলে নাকি মেয়ে। মেয়ে নাকি ছেলে।
ভাবীর সিজার হচ্ছে। বাইরে আমরা অপেক্ষায়।
খুব কষ্ট লেগেছিল সেদিন। এতো কিছু করেও আমি পারলাম না। সবই আল্লাহর হাতে। আমার ভাতিজা জীবিত ছিল না। বাচ্চাটা পেটেই মারা গিয়েছে। শুনে সবাই কান্না শুরু করে দিল। আব্বা কঠিন মনের মানুষ কিন্তু সেদিন তিনিও কাঁদছিলেন।
আমি বাচ্চা মানুষের মতো কান্না করছিলাম।
বেশ কয়েকদিন পর
ভাবী এখন সুস্থ। বাসাতে নিয়ে আসা হয়েছে দুদিন হলো। আমি ভাবীর রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। মন খুব খারাপ আমার। আমি কাকা হতে পারলাম না।
ভাবী আমাকে ডাকলেন। শুনে আমি রুমে গেলাম। ভাবী বললেন," মন খারাপ করে আছো কেন আকাশ?"
ভাবীর প্রশ্ন শুনেই কান্না চলে আসলো আমার। ভাবী আমার পাশে এসে বসলেন। পরম মমতায় আমার মাথায় হাত রেখে বলতে লাগলেন, " জানিস ভাই আমার কোনো কষ্ট নাই। সন্তান যদি আল্লাহ আর নাও দেয় কষ্ট নাই। আরে তুই কী শুধুই আমার ভাই। তুই তো আমার সন্তানও। একজন মানুষের জন্য এতোকিছু যে ছেলেটা করতে জানে সেই ছেলেটার ছোট্ট মনটাতে কত্ত আঘাত দিয়েছি। সেগুলা আল্লাহও হয়ত সহ্য করেনি। আমায় মাফ কর ভাই। "
এসব শুনে আমি ভাবীর পা ধরে কান্না করছি। " ভাবীগো আপনার ভালবাসা যেন আজীবন এভাবে পেতে পারি। ভাবী আমাকেও ক্ষমা কইরেন।"
দুজনের চোখ দিয়েই অশ্রু ঝড়ছিল বিরামহীন ভাবে।
তখন বিকাল শেষ হয়ে এসেছে। যথারীতি সূর্যটা ঢুবতে শুরু করেছে। পাখিরাও তাদের বাসায় আসতে শুরু করেছে ক্লান্ত দেহ নিয়ে। গরু-বাছুর নিয়ে রাখালেরাও হয়ত তখন বাড়ির পথে। আর আমি সেদিন ঠিক সে মূহুর্তে পেয়েছিলাম একটা পবিত্র, সুমিষ্ট, স্বার্থহীন ভালোবাসার সংজ্ঞা।