সমাজ বাস্তব জীবনের গল্প
গল্প: কালো রং এর মেয়েটা
আফরিন ছোটবেলা থেকেই একটু চাপা স্বভাবের মেয়ে। মিষ্টি হাসি, শান্ত চেহারা, নম্র ব্যবহার—সবই ছিল ওর মধ্যে। কিন্তু একটা জিনিস ছিল না, সমাজের চোখে ‘সৌন্দর্য’। ওর গায়ের রঙ একটু চাপা, গাঢ় শ্যামলা। আর সেটাই যেন হয়ে দাঁড়াল ওর জীবনের সব সমস্যার মূল।
স্কুল থেকে কলেজ—সবসময়ই আফরিন শুনেছে, “তুই এত ভালো কিন্তু… তোর রঙটা যদি একটু ফর্সা হতো!” কেউ সামনে বলে দিয়েছে, কেউ পিছনে ফিসফিস করে। ওর বান্ধবীরা প্রেম করে, কেউ কেউ বিয়েও করে ফেলেছে, অথচ আফরিন? একটা ছেলেও কখনো কাছে আসেনি, বা এলেও খুব দ্রুত সরে গেছে।
এর মাঝে ওর জীবনে আসে রবিন। রবিন দেখতে বেশ স্মার্ট, মিশুক, আর কথায় কথায় হাসে। ওর সাথেই অফিসে কাজ করে আফরিন। রবিন একটু অন্যরকম ছিল বলে মনে হয়েছিল। ওর সঙ্গে কথা বলত, কফি খেতে ডাকত, অনেকক্ষণ গল্প করত। আফরিনের মনে হয়েছিল, এই প্রথম কেউ বুঝি ওকে সত্যিই বুঝছে, ভালোবাসতে চাইছে।
কিন্তু গল্পটা এখানে থেমে থাকেনি।
একদিন রবিন হঠাৎ অফিসে আফরিনের হাত ধরে বলল, “তুমি খুব ভালো। আমি সত্যি তোমাকে পছন্দ করি।” আফরিনের চোখ ভিজে উঠেছিল আনন্দে। অনেকদিন পরে মনে হয়েছিল, সমাজের সেই রঙভিত্তিক দেয়ালটা কেউ যেন ভেঙে ফেলেছে।
তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়, কিছুদিন পর রবিন নিজেই বলল, “চলো, এবার আমরা পরিবারে বলি।”
আফরিন বিশ্বাস করে রবিনকে, বাসায় বলে। মা-বাবা একটু অবাক হলেও মেয়ের খুশির জন্য রাজি হয়।
কিন্তু ঠিক তখনই একদিন রবিন ফোন করে বলে, “আমার বাড়িতে খুব চাপ। মা বলছে তোর রঙ দেখে কিছুতেই মানবে না। আমি কি করব বলো?”
আফরিন কাঁপা গলায় বলেছিল, “তুমি কি চাও?”
রবিন একটু চুপ থেকে বলেছিল, “তোমাকে ভালোবাসি তো, কিন্তু... মাকে তো ফেলে দিতে পারি না।”
কিছুদিন পর রবিন বিয়ে করে—এক ফর্সা মেয়েকে। ফেসবুকে ছবি দেখে আফরিন বুঝেছিল, এই তো, এই সমাজ আসলে চায় ফর্সা, চোখধাঁধানো সৌন্দর্য। চরিত্র, হৃদয়, ভালোবাসা এগুলো কেবল গল্পের বইয়ে থাকে।
আফরিন আর কিছু বলে না, শুধু ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে নিজেই ফিরে যায়। ও জানে, সমাজ তাকে ভালোবাসবে না, কিন্তু সে নিজেকে ভালোবাসতে শিখবে।
আজও সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কেউ বলে, “চেহারাটা একটু ভালো হলে বেশ লাগতো!”
কিন্তু এখন সে মুখ ঘুরিয়ে হাসে, ভাবে—
“তোমাদের চোখে আমি কালো, কিন্তু আমার আত্মা অন্ধকার নয়। তোমরা শুধু গায়ের রঙ দেখো, মন নয়।”
এটা শুধু আফরিনের গল্প নয়—এই সমাজে হাজার হাজার মেয়ের গল্প, যারা এখনো রঙের নামে ভালোবাসা হারায়, অপমান পায়, একা থাকে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে জিতিয়ে নিতে জানে। কারণ তারা জানে, ভালোবাসা পাওয়া নয়, নিজেকে ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় জয়।